বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংক—অগ্রণী, জনতা, বেসিক ও রূপালী—দ্বারা জমা দেওয়া মূলধন পুনরুদ্ধার পরিকল্পনাকে “অবাস্তব” বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, বিশাল মূলধন ঘাটতি মোকাবিলায় এসব ব্যাংকের প্রস্তাব বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোকে ২০২৯ সালের মধ্যে এই ঘাটতি কমানোর জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অন্য দুই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক—সোনালী ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)—৪,৭৬৩ কোটি টাকার প্রভিশনিং ঘাটির মুখে থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘প্রোভিশন ফরবেয়ারেন্স’ সুবিধার কারণে তাদের ১৬৭ কোটি টাকার মূলধন উদ্বৃত্ত দেখা দিয়েছে।
অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা ‘অবাস্তব’:
অগ্রণী ব্যাংক আগামী পাঁচ বছরে মূলধন ঘাটতি ৬,২৪৫ কোটি টাকা কমানোর পরিকল্পনা জমা দিয়েছে। তবে ব্যাংকের গত বছরের নিট লোকসান ৯৩৭ কোটি টাকা। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে তিন বছরের মধ্যে ব্যাংক দুই বছরে মাত্র ১৮০ কোটি টাকার নিট মুনাফা দেখাতে পেরেছে। এরপরই ব্যাংক লোকসানে পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো ব্যাংক মূলধন ঘাটতি কাটাতে পারে প্রধানত তিনভাবে—নিট মুনাফা বাড়িয়ে, সরকারের পুনঃমূলধন সহায়তা নিয়ে, অথবা খেলাপি ঋণ কমিয়ে। অগ্রণী ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই তিনটির কোনোই ইতিবাচক নয়। এজন্য জ্যেষ্ঠ ব্যাংকাররা বড় অংকের মূলধন পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয় বলে মন্তব্য করছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তাই অগ্রণী ব্যাংকের পরিকল্পনা ফেরত পাঠিয়েছে। ব্যাংককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, প্রকৃত আর্থিক অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে। ব্যাংকের নিজস্ব তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে অগ্রণী ব্যাংকের বাধ্যতামূলক ন্যূনতম মূলধন (এমসিআর) ছিল ৯,৪৪৪ কোটি টাকা। বাস্তবে ব্যাংক রাখতে পেরেছে মাত্র ১,৭৫২ কোটি টাকা। ফলে মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭,৬৯২ কোটি টাকায়।
অগ্রণী ব্যাংক যদিও মূলধন ঘাটতি কমানোর জন্য পাঁচ বছরের একটি কর্মপরিকল্পনা জমা দিয়েছে, তবে এটি অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে এক বছরে ঘাটতি কমানো হবে ৩,১৪০ কোটি টাকা; ২০২৬ সালে ৫২৩ কোটি; ২০২৭ সালে ১,৩০১ কোটি। তবে ২০২৮ সালে নতুন করে ৪০০ কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হবে। শেষ বছর ২০২৯ সালে ঘাটতি কমানো হবে ১,৬৮০ কোটি টাকায়। অগ্রণী ব্যাংকের ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের প্রভিশন ঘাটতি ১২,৭৯০ কোটি টাকা। ব্যাংকের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৮ সালের মধ্যে এটি কমিয়ে আনা হবে ১,২৬৭ কোটি টাকায় এবং ২০২৯ সালে প্রভিশন ঘাটতি শূন্যে নামবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো উন্নীত করতে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংককে পাঠানো হয়েছে। এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মূলধন ঘাটতি ৮,৬২১ কোটি টাকা। ব্যাংক বলছে, ২০২৯ সালের মধ্যে ঘাটতি কমিয়ে ৩,২৫৭ কোটি টাকায় আনা হবে। অর্থাৎ পাঁচ বছরে ঘাটতি কমানো হবে ৫,৩৬৪ কোটি টাকা। তবে ২০২২, ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে যথাক্রমে ১৩০ কোটি, ৪১৬ কোটি ও ৮৬৩ কোটি টাকার নিট লোকসান হয়েছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত আরও ৫৭৭ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে।
বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, ব্যাংককে লাভজনক পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, ২০২৪ সালে গণমাধ্যমে মার্জার সংক্রান্ত সংবাদের কারণে ব্যাংকের আমানত কমে যায় ও লোকসান বৃদ্ধি পায়। নভেম্বর থেকে নতুন পর্ষদ দায়িত্ব গ্রহণ করে নিয়মিতভাবে গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করা হয় এবং আস্থা ফিরিয়ে আনতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
জনতা ব্যাংকের কর্মপরিকল্পনা বলছে, ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২০২৪ সালের ১০,৭০০ কোটি টাকা থেকে ২০২৯ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ২০,৬০০ কোটি টাকায়। অন্যদিকে প্রভিশনিং ঘাটতি ৪৭,৩০০ কোটি থেকে কমে ৩০,২৪০ কোটি টাকায় নামবে। তবে ব্যাংকটি ২০২৪ সালে ৩,০৭১ কোটি টাকা এবং ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে আরও ৩,০০০ কোটি টাকার নিট লোকসান করেছে, যা পরিকল্পনার বাস্তবতা প্রশ্নবিদ্ধ করে।
রূপালী ব্যাংক ২০২৪ সালের শেষে ৩,৯৭০ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি নিয়ে তুলনামূলক সংযত ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা জমা দিয়েছে। ব্যাংকের লক্ষ্য ২০২৯ সালের মধ্যে ঘাটতি কমিয়ে ২,৯৯১ কোটি টাকায় নামানো। প্রভিশনিং ঘাটতিও ১২,০১৪ কোটি থেকে কমিয়ে ১১,৬০০ কোটি টাকায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। গত তিন বছরে রূপালী ব্যাংক ৮৩ কোটি টাকার নিট মুনাফা করেছে।
সোনালী ব্যাংক ২০২৪ সালের শেষে ৬৪ কোটি টাকার মূলধন উদ্বৃত্ত দেখিয়েছে। ব্যাংকের লক্ষ্য ২০২৯ সালে এটি ৫,৮৪২ কোটি টাকায় উন্নীত করা। একই সময়ে ৪,৬৩২ কোটি টাকার প্রভিশনিং ঘাটতি ৮৩১ কোটি টাকার উদ্বৃত্তে পরিণত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০২২ সাল থেকে সোনালী ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে তিন বছর মুনাফা দেখিয়েছে; মোট মুনাফা ১,৮৮৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল) বর্তমানে ১০৩ কোটি টাকার মূলধন উদ্বৃত্তে আছে। ব্যাংকের লক্ষ্য ২০২৯ সালে এটি ৩৯৭ কোটি টাকায় উন্নীত করা। এই তথ্যগুলো দেখাচ্ছে যে, রূপালী, সোনালী ও বিডিবিএলের পরিকল্পনা তুলনামূলকভাবে বাস্তবসম্মত, যেখানে অগ্রণী, বেসিক ও জনতা ব্যাংকের কর্মপরিকল্পনা অনেকাংশে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও ঝুঁকিপূর্ণ।
ব্যাংকের ব্যালান্স শিটে জরুরি সংস্কার প্রয়োজন:
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর জন্য শুধু মুনাফা বাড়ানোই যথেষ্ট নয়। টেকসই সমাধান আনার জন্য দরকার সার্বিক ব্যালান্স শিট পুনর্গঠন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর তৎপরতার সমন্বিত পদক্ষেপ। বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাব করেছেন—সরকারি পুনঃপুঁজিযুক্তকরণ, খেলাপি ঋণ কমাতে বিশেষ পুনরুদ্ধার টিম গঠন, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি, জামানত বিক্রি এবং ওয়ান-টাইম সেটেলমেন্ট (ওটিএস) ব্যবহারে জোর দেওয়া। কারণ খেলাপি ঋণ কমলে প্রভিশনিং প্রয়োজন কমে যায়, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূলধনকে শক্তিশালী করে।
এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ঋণের সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে ‘লোন লস প্রভিশন’ হ্রাস, ব্যালান্স শিটে থাকা ভবন ও জমির সম্পদমূল্য পুনঃপর্যালোচনা করে রিভ্যালুয়েশন রিজার্ভ যোগ করা, বাজার থেকে টিয়ার-১ বা টিয়ার-২ বন্ড জারি করে মূলধন সংগ্রহ এবং পরিচালন ব্যয় হ্রাস—এসবও মূলধন ঘাটতি কমানোর প্রচলিত উপায়। তাছাড়া অকার্যকর শাখা বন্ধ করা, ডিজিটাল চ্যানেল বৃদ্ধি এবং ফি-ভিত্তিক আয় বাড়ানো—এসব পদক্ষেপও বিশেষজ্ঞরা ব্যাংকগুলোর টেকসই স্থিতিশীলতার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন।
বাংলাদেশে ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি ১.৫৫ লাখ কোটি টাকা:
চলতি বছরের জুন শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এটি মার্চ শেষে থাকা ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার তুলনায় অনেক বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ২৪টি বাধ্যতামূলক ন্যূনতম মূলধন ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকের মধ্যে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক এবং ১৮টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে।

