সমস্যাজনক ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) অবসায়নের সিদ্ধান্ত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় এই অনুমোদন দেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
ফলে অনিয়ম, লুটপাট ও অর্থনৈতিক অযোগ্যতার কারণে ধুঁকতে থাকা ৯টি প্রতিষ্ঠান লিকুইডেশনের মাধ্যমে বন্ধের পথে যাবে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, আভিভা ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি এবং প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ব্যাংক রেজোলিউশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫-এর আওতায় সমস্যাজনক এনবিএফআই লিকুইডেশনের বিধান রয়েছে। তবে অবসায়নের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। রোববার তা অনুমোদিত হয়েছে। এখন কোন প্রতিষ্ঠানগুলো অবসায়ন হবে, তা যাচাই-বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত করা হবে।
কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন সূচক বিবেচনা করে ৯টি প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বোর্ড অনুমোদনের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এর আগে এসব প্রতিষ্ঠানকে ‘অব্যবহারযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তিনটি প্রধান কারণে— আমানতকারীর টাকা ফেরত দিতে না পারা, উচ্চ খেলাপি ঋণ এবং মূলধন ঘাটতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধে সরকারের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের বর্তমান অবস্থা অনুযায়ী—
- এফএএস ফাইন্যান্স: খেলাপি ঋণ ৯৯.৯৩%, ক্ষতিপূরণ ১,৭১৯ কোটি টাকা
- ফারইস্ট ফাইন্যান্স: খেলাপি ৯৮%, ক্ষতি ১,০১৭ কোটি
- বিআইএফসি: খেলাপি ৯৭.৩০%, ক্ষতি ১,৪৮০ কোটি
- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং: খেলাপি ৯৬%, ক্ষতি ৪,২১৯ কোটি
- পিপলস লিজিং: খেলাপি ৯৫%, ক্ষতি ৪,৬২৮ কোটি
- আভিভা ফাইন্যান্স: খেলাপি ৮৩%, ক্ষতি ৩,৮০৩ কোটি
- প্রিমিয়ার লিজিং: খেলাপি ৭৫%, ক্ষতি ৯৪১ কোটি
- জিএসপি ফাইন্যান্স: খেলাপি ৫৯%, ক্ষতি ৩৩৯ কোটি
- প্রাইম ফাইন্যান্স: খেলাপি ৭৮%, ক্ষতি ৩৫১ কোটি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানায়, ২০২৩ সালে প্রণীত ‘ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন’ অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনের ৭(১) ধারা অনুযায়ী, আমানতকারীর স্বার্থের পরিপন্থি কার্যক্রম, দায় পরিশোধে সম্পদের অপর্যাপ্ততা ও মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থতার কারণে লাইসেন্স বাতিলের সুযোগ রয়েছে। ৭(২) ধারা অনুযায়ী, নোটিশ দিয়ে ১৫ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিতে হয়। গত ২২ মে এসব প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। সন্তোষজনক জবাব না আসায় অবসায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে দেশে ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি সমস্যাজনক হিসেবে চিহ্নিত। এই প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ ২৫,৮০৮ কোটি টাকা, যার ২১,৪৬২ কোটি টাকা খেলাপি। খেলাপির হার ৮৩.১৬ শতাংশ। তবে বন্ধকি সম্পদের মূল্য মাত্র ৬,৮৯৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে ১৫টি তুলনামূলক ভালো প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণের মাত্র ৭.৩১ শতাংশ। এরা গত বছর ১,৪৬৫ কোটি টাকা মুনাফা করেছে এবং মূলধনে ৬,১৮৯ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, মোট আর্থিক খাতের আমানত ৪৮,৯৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সমস্যাজনক ২০ প্রতিষ্ঠানের আমানত ২২,১২৭ কোটি টাকা। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা আরও ৫,১৬৪ কোটি টাকা। নিট ব্যক্তি আমানতের পরিমাণ প্রায় ৪,৯৭১ কোটি টাকা। অবসায়ন ও পুনর্গঠনের প্রাথমিক ধাপে এই অর্থের জোগান প্রয়োজন হতে পারে। কর্মচারীরা চাকরিবিধি অনুযায়ী সব সুবিধা পাবেন।

