দীর্ঘদিন গোপন রাখা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে। গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এই ঋণের আকার সর্বাধিক উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে মন্দ ও ক্ষতিজনক ঋণ, যা আদায়ের সম্ভাবনা কম, আংশিকভাবে অবলোপন করা সম্ভব হবে। এতে ব্যালান্স শিটে ঋণের আকার কম দেখানো যাবে।
গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন একটি সার্কুলার জারি করেছে। এতে আগের একটি প্রজ্ঞাপন সংশোধন করা হয়েছে, যেখানে এই সুবিধা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এই নির্দেশনা অবিলম্বে কার্যকর হবে।
যৌক্তিকতা ও বৈশ্বিক নজির:
নতুন সার্কুলারে বলা হয়েছে, আগের নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলো মন্দ ও ক্ষতিজনক ঋণ ব্যালান্স শিটে দেখাতে বাধ্য ছিল। ফলে ঋণের প্রকৃত অবস্থা ধরা পড়ত না এবং ব্যাংকের সম্পদের সঠিক মান নির্ধারণ কঠিন হয়ে যেত। বাংলাদেশ ব্যাংকের যুক্তি, ঋণের আংশিক অবলোপন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য। ব্যাসেল নীতি ও আইএফআরএস অনুযায়ী বিশ্বের বহু দেশে এই পদ্ধতি চালু। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে ব্যাংকিং খাতে এটি প্রচলিত।
রেকর্ড খেলাপি ঋণ:
দেশের ব্যাংকিং খাতের সংকটের মধ্যেই নতুন নির্দেশনা এসেছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। nগত বছরের জুনে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২.১১ লাখ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১২.৫ শতাংশ। ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৩.৪৫ লাখ কোটি টাকায়, মোট ঋণের ২০.২০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে ৬.৪৪ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এটি মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৫.৭৩ শতাংশ, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
ব্যাংক খাতে দুর্নীতি, গভর্নরের সতর্কবার্তা ও আংশিক অবলোপন নীতি”
২০২৪ সালের আগস্টে দায়িত্ব নেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আগে থেকেই সতর্ক করেছিলেন, খেলাপি ঋণের হার ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, “গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে যে পরিমাণ অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুণ্ঠন হয়েছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এস আলম ও বেক্সিমকোসহ কিছু গ্রুপ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা নিয়েছে।” কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতিতেও উল্লেখ ছিল, খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশ ছাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী পদ্ধতিগত দুর্বলতা, নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি, অর্থ পাচার ও শোষণমূলক অনুশীলন।
আংশিক অবলোপনের শর্তাবলি:
নতুন নীতিমালার আওতায় মন্দ ও ক্ষতিজনক ঋণ, যা ভবিষ্যতে আদায়ের সম্ভাবনা কম, আংশিকভাবে অবলোপন করা যাবে। তবে যে অংশের বিপরীতে যোগ্য জামানত আছে, তা আদায়যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। শুধু অবশিষ্ট অংশকে নীতিমালার আওতায় অবলোপন করা যাবে।
ব্যাংক চাইলে নিজে বা পেশাদার জামানত মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান দ্বারা ঋণের বন্ধকীকৃত জামানতের প্রকৃত বাজারমূল্য নির্ধারণ করতে পারবে। আংশিক অবলোপনের ক্ষেত্রে, ঋণের আসল ও সুদের অংশের মধ্যে আগে সুদের অংশ অবলোপন করতে হবে। অনারোপিত সুদের অংশও আনুপাতিক হারে আলাদাভাবে হিসাবায়ন করতে হবে।
ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে জামানত ছাড়া আদায়কৃত অর্থ দিয়ে প্রথমে অবলোপনকৃত ঋণের অর্থ সমন্বয় করতে হবে। যদি আদায়কৃত অর্থ অবলোপিত ঋণের চেয়ে বেশি হয়, বকেয়া ঋণ সমন্বয় করতে হবে। আংশিক অবলোপনের পর অবশিষ্ট ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবে বা ‘এক্সিট সুবিধা’ দিতে পারবে।
ব্যাংকারদের স্বাগত:
উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতেও আংশিক অবলোপনের পদ্ধতি প্রচলিত। শীর্ষ ব্যাংকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হুসেইন বলেছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি বলেন, মন্দ ঋণের আদায়-অযোগ্য অংশ অবলোপন করলে খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান ও প্রভিশন সংরক্ষণের ওপর চাপ কমবে। এর ফলে ঋণ আদায়ের প্রচেষ্টায় কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কারণ অবলোপনকৃত ঋণের আদায়ের জন্য ব্যাংকগুলোর আলাদা ইউনিট রয়েছে।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আনোয়ারুল ইসলাম নীতিটিকে ‘ইতিবাচক’ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এটি ব্যাংকের ব্যালান্স শিটে খেলাপি ঋণের চাপ কমাবে। তবে পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রজ্ঞাপনের কিছু শর্ত নিয়ে সম্ভাব্য ব্যবহারিক জটিলতার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, আরোপিত সুদের অংশ আগে অবলোপন করার নির্দেশনা ঋণ দ্রুত নিষ্পত্তিতে জটিলতা তৈরি করতে পারে। এছাড়া আংশিক নিষ্পত্তি পরিকল্পনায় গ্রাহকদের ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত হতে পারে।
সুস্পষ্ট গাইডলাইনের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের:
অর্থনীতিবিদরা আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা গ্রহণকে স্বাগত জানালেও সতর্ক করেছেন। সিপিডি’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, নীতি যদি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে কঠোরভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে খেলাপি ঋণ হ্রাসে এটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুস্পষ্ট গাইডলাইন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে কোন গোষ্ঠীকে অন্যায্য সুবিধা দেওয়া না হয়। বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে নীতি প্রয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।

