দীর্ঘদিন গোপন থাকা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ্যে আসে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর। পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠায় এখন ব্যালান্স শিটে খেলাপি ঋণের চাপ কমাতে মন্দ ও ক্ষতিজনক শ্রেণির ঋণ আংশিক অবলোপনের সুযোগ দিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) জারি করা নতুন সার্কুলারটি অবিলম্বে কার্যকর হবে। এতে আগের যেসব নিয়মে এই সুবিধা ছিল না, সেগুলো সংশোধন করা হয়েছে।
কেন এই সিদ্ধান্ত
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, মন্দ ও ক্ষতিজনক ঋণের বড় অংশ অনাদায়ী থাকা সত্ত্বেও তা ব্যালান্স শিটে দেখানো হচ্ছিল। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে উঠছিল। ফলে ব্যাংকের প্রকৃত সম্পদমান নির্ধারণ কঠিন হয়ে পড়েছিল।
আংশিক অবলোপনকে ব্যাসেল নীতি ও আইএফআরএস অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য বলা হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশেই এই পদ্ধতি বহু বছর ধরে প্রচলিত।
খেলাপি ঋণে রেকর্ড
ব্যাংকিং খাত এখন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংকটের মধ্যে রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে গত বছরের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল ২.১১ লাখ কোটি টাকা—মোট ঋণের ১২.৫ শতাংশ। বছর শেষ হওয়ার আগেই তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩.৪৫ লাখ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ২০.২০ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে ৬.৪৪ লাখ কোটি টাকা হয়েছে। এটি মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৫.৭৩ শতাংশ। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনও এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
গভর্নরের সতর্কতা
২০২৪ সালের আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আগেই সতর্ক করেছিলেন—খেলাপি ঋণের হার ৩৫ শতাংশ ছাড়াতে পারে। তাঁর বক্তব্য ছিল, গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে যেসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে, তা পৃথিবীতেও বিরল। তাঁর মতে, এস আলম ও বেক্সিমকোসহ কয়েকটি গ্রুপ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতিতেও বলা হয়েছিল, খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশ ছাড়ানোর ঝুঁকি বাড়ছে। এর পেছনে নিয়ন্ত্রণ দুর্বলতা, অর্থ পাচার ও শোষণমূলক অনুশীলনকে দায়ী করা হয়।
আংশিক অবলোপনের নিয়ম
নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, মন্দ ও ক্ষতিজনক শ্রেণির এবং ভবিষ্যতে আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ এমন ঋণ আংশিক অবলোপন করা যাবে। তবে যে অংশের বিপরীতে যোগ্য জামানত আছে, সেটিকে আদায়যোগ্য হিসেবেই ধরা হবে। শুধু অবশিষ্ট অংশই অবলোপনের আওতায় আসবে।
ব্যাংক চাইলে নিজস্ব ব্যবস্থায় বা পেশাদার মূল্যায়নকারী দিয়ে জামানতের বাজারমূল্য নির্ধারণ করতে পারবে।
অবলোপনের ক্ষেত্রে প্রথমে সুদের আরোপিত অংশ বাদ দিতে হবে। এরপর অনারোপিত সুদ আলাদা করে হিসাবায়ন করতে হবে। আর জামানত ছাড়া ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে যেটুকু আদায় হবে, তা দিয়ে আগে অবলোপনকৃত অংশ সমন্বয় করতে হবে। বেশি আদায় হলে তা বাকি ঋণ সমন্বয়ে যাবে।
অবলোপনের পর ব্যাংক চাইলে ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবে বা ‘এক্সিট সুবিধা’ দিতে পারবে।
ব্যাংকারদের প্রতিক্রিয়া
আংশিক অবলোপনকে বেশিরভাগ ব্যাংকার স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, এটি উন্নত দেশের আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ব্যাংক এশিয়ার এমডি সোহেল আর কে হুসেইন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলোও এ নিয়ম অনুসরণ করে। এতে খেলাপি ঋণের পরিসংখ্যান বাস্তবসম্মত হবে এবং প্রভিশনের চাপ কমবে। তাঁর মতে, অবলোপনের কারণে ঋণ আদায়ে কোনো প্রভাব পড়বে না, কারণ ব্যাংকগুলোর আলাদা রিকভারি ইউনিট রয়েছে।
অগ্রণী ব্যাংকের এমডি মো. আনোয়ারুল ইসলামও এটিকে ‘ইতিবাচক’ পদক্ষেপ বলেছেন। তবে তিনি জোর দিয়েছেন—সবকিছুই স্বচ্ছতা এবং কঠোর নজরদারির আওতায় করতে হবে।
তবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান কিছু ব্যবহারিক জটিলতার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, আরোপিত সুদ আগে অবলোপনের নিয়ম ঋণ নিষ্পত্তির গতি কমিয়ে দিতে পারে। এতে আংশিক নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার সুযোগও সংকুচিত হতে পারে।
অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড গ্রহণ অবশ্যই ইতিবাচক। তবে এই নীতি বাস্তবায়নে সুশাসন নিশ্চিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান মনে করেন, নীতিটি কঠোরভাবে অনুসরণ করা গেলে খেলাপি ঋণ কমাতে সহায়ক হবে। তবে তিনি স্পষ্ট গাইডলাইন দেওয়ার আহ্বান জানান—কারা এই সুবিধা পাবেন এবং কাদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে।
তিনি সতর্ক করেন, আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে কোনো বিশেষ গোষ্ঠী যেন অন্যায্য সুবিধা না পায়। নীতির প্রয়োগে স্বচ্ছতা তাই অপরিহার্য।

