রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া এসএস পাওয়ার লিমিটেডের বিদেশি ঋণের ২৮৩ মিলিয়ন ডলার দুটি কিস্তিতে পরিশোধ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, অনুমোদন ছাড়া ঋণ পরিশোধ চুক্তির শর্তের ব্যত্যয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক রূপালী ব্যাংকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা চেয়েছে। ব্যাংকটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বাঁশখালীর গন্ডামারা এলাকায় স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এস আলম গ্রুপ ও চীনের সেপকো থ্রি-র যৌথ মালিকানাধীন। বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস আলম গ্রুপের মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদ।
চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, রূপালী ব্যাংক অনুমোদন ছাড়া ব্যাংক অভ চায়নার সিঙ্গাপুর শাখায় ঋণের অর্থ পাঠিয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয় কিস্তি ১৪০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয় ২০২৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর এবং চতুর্থ কিস্তি ১৪৩ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয় ২০২৫ সালের ২৩ জুন। তবে ঋণের প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তি, মোট ২৪৩.৭৬ মিলিয়ন ডলার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে পরিশোধ করা হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী প্রথম কিস্তিটি ছিল স্বয়ংক্রিয় এবং দ্বিতীয় কিস্তিটি ২০২৪ সালের ২০ জুন অনুমোদনের ভিত্তিতে ইসলামী ব্যাংক পরিশোধ করেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ ও ২০৩৫ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যাংক অভ চায়না থেকে ১ হাজার ৬৯৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ৫৭৫ মিলিয়ন ডলার (মূল ও সুদসহ) ইতিমধ্যেই পরিশোধ করা হয়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও এসএস পাওয়ারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে প্রকল্পটির উদ্বোধন করেছিলেন।
এরপর রূপালী ব্যাংক এসএস পাওয়ারের বিদেশি ঋণের কয়েকটি কিস্তি অনুমোদন ছাড়া পরিশোধ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বাকি কিস্তির টাকা পরিশোধের জন্য রূপালী ব্যাংক আবার পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করবে। আবেদন এলে অনুমোদন দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, “পঞ্চম কিস্তি পরিশোধের জন্য রূপালী ব্যাংককে অবশ্যই অনুমোদন নিতে হবে। আবেদন জমা দিলেই অনুমোদন দেওয়া হবে।”
রূপালী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অর্থ ঠিক যেখানে পরিশোধ হওয়ার কথা ছিল, সেটি হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন অনুসারে দেওয়া হয়নি। এর কারণ একটি টেকনিক্যাল সমস্যা, যা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়নি। তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি পাওয়ার পর বাকি কিস্তির অর্থ পাঠানোর আগে অনুমোদন নেওয়া হবে।
তিনি আরও ব্যাখ্যা করেন, কয়েকটি ধাপ পার হয়ে মূল অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছায়। এর মধ্যে একটি ধাপ ফরেন কারেন্সি (এফসি) অ্যাকাউন্ট। এফসি অ্যাকাউন্টে অর্থ ক্রেডিট করা যায়, কিন্তু ডেবিট করা যায় না। এজন্য সরাসরি মূল অ্যাকাউন্টে অর্থ পাঠানো হয়েছে। এছাড়া, এসএস পাওয়ার যে অর্থ পরিশোধ করেছে, তা দিয়েই ডলার কেনা হয়েছে। এ পর্যন্ত যত পেমেন্ট পরিশোধ হয়েছে, সবই এসএস পাওয়ারের পক্ষ থেকে হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
রূপালী ব্যাংকের ব্যাখ্যা:
রূপালী ব্যাংক পিএলসি জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) অনুমোদিত ঋণের কিস্তি বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বনুমোদন ব্যতীত পরিশোধ করা যেতে পারে। এসএস পাওয়ার ১ লিমিটেডের ক্ষেত্রে ব্যাংকটি কিছু বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে।
ব্যাংক অভ চায়না, রূপালী ব্যাংক পিএলসি, আরও ছয়টি চীনা ঋণদাতা ব্যাংক ও এসএস পাওয়ার ১ লিমিটেডের মধ্যে স্বাক্ষরিত অ্যাকাউন্টস অ্যাগ্রিমেন্ট অনুযায়ী মোট ১০টি ভিন্ন অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এর মধ্যে দুটি বিশেষ অ্যাকাউন্ট—ডেবট সার্ভিস রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট (ডিএসআরএ) ও ডেবট সার্ভিস অ্যাক্রুয়াল অ্যাকাউন্ট (ডিএসএএ)—ঋণ পরিশোধের স্বচ্ছতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হয়।
ডিএসআরএর মূল উদ্দেশ্য হলো ঋণের একটি পূর্ণ কিস্তির সমপরিমাণ অর্থ জমা রাখা, যা পুরো ঋণের মেয়াদে রক্ষিত থাকে। ডিএসএএর কাজ হলো প্রতি মাসে তহবিল জমা রাখা, যাতে নির্ধারিত কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করা যায়। যদি ডিএসএএতে পর্যাপ্ত তহবিল না থাকে, তবে ডিএসআরএ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিস্তির অর্থ কেটে নেওয়া হয়। ডিএসএএ-এর তহবিল শুধুমাত্র ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যবহৃত হয়।
প্রথম কিস্তি পরিশোধের সময়, এসএস পাওয়ারকে প্রথমে ডিএসআরএতে অর্থ সংরক্ষণ করতে হয়েছিল। পরে ডিএসএএতে তহবিল স্থানান্তর করা হয়। ২০২৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসএস পাওয়ার বিপিডিবিকে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করেনি, ফলে ডিএসএএ-তে প্রয়োজনীয় তহবিল গঠন ব্যর্থ হয়। এই পরিস্থিতিতে ঋণদাতারা ডিএসআরএ থেকে সমপরিমাণ অর্থ কেটে প্রথম কিস্তি পরিশোধ হিসেবে গ্রহণ করে। এই তহবিল ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয় কিস্তি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির মাধ্যমে ১০১ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়। যেহেতু ইসলামী ব্যাংক মূল অ্যাকাউন্টস অ্যাগ্রিমেন্টের অংশ ছিল না, তাই বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল। তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির সময় রূপালী ব্যাংক সরাসরি এফসি অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ ডেবিট করতে পারেনি। ব্যাংকটির অফশোর ব্যাংকিং সুবিধা না থাকার কারণে এবং দ্বৈত মুদ্রায় দৈনন্দিন লেনদেন পরিচালনা করতে না পারার কারণে নির্ধারিত সময়মতো ঋণ পরিশোধ বাধ্যতামূলক হওয়ায়, ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিডার অনুমোদন অনুযায়ী অর্থ সরাসরি ডিএসএএ-তে জমা করেছে।
রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, “আমি সঠিক তথ্য দিতে পারব না। বিস্তারিত জানার জন্য লোকাল অফিসে যোগাযোগ করা উচিত।” পরে ব্যাংকের কমিউনিকেশন বিভাগ লিখিত ব্যাখ্যা প্রদান করেছে।

