অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মফিজ উদ্দীন আহমেদ রাষ্ট্রমালিকানাধীন রূপালী ব্যাংক থেকে ২০২২ সালের মে মাসে ৭৫ লাখ টাকা ঋণ নেন কিন্তু ব্যাংকের এককালীন ঋণ পরিশোধের চাপ, হিসাব অবরুদ্ধ ও নিয়মবহির্ভূত আচরণের কারণে তিনি বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন বলে জানান এই অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
ঘটনাটি রূপালী ব্যাংক থেকে শুরু হয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ হয়ে অর্থ বিভাগ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এতে সরকারি কর্মচারীদের জন্য গৃহঋণ গ্রহণ প্রক্রিয়া ও ব্যাংকগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রণীত গৃহনির্মাণ নীতিমালা অনুযায়ী, মফিজ উদ্দীন আহমেদের ২০ বছরে মোট ২৪১ কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের কথা। ঋণ নেওয়ার পর নিজস্ব অর্থ যোগ করে তিনি ঢাকায় দেড় কোটি টাকায় একটি ফ্ল্যাট কেনেন। ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে তিনি নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করে আসছেন।
এক বছরের অবসর-উত্তর ছুটি শেষে ২০২৫ সালের ১ জুলাই তিনি অবসরে যান। কিন্তু দুই মাসের মাথায় ৩ সেপ্টেম্বর রূপালী ব্যাংকের করপোরেট শাখা তাঁকে উপস্থিত হতে বলে। সেখানে গিয়ে তিনি একটি চিঠি পান, যেখানে বলা হয় ৪৭ লাখ টাকা এককালীন পরিশোধ করতে হবে, বাকি টাকা কিস্তিতে দেওয়া যাবে। নিয়মিত কিস্তি পরিশোধকারী গ্রাহক হিসেবে এই চাপ মফিজ উদ্দীনের কাছে অবোধ্য মনে হয়েছে।
তিনি বিষয়টি লিখিতভাবে অর্থ বিভাগকে জানান। পর্যালোচনায় দেখা যায়, রূপালী ব্যাংকের এ পদক্ষেপ সরকারি কর্মচারীদের জন্য গৃহনির্মাণ ঋণ নীতিমালা ২০১৮-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নীতিমালায় উল্লেখ আছে, অবসরের পর কিস্তি বকেয়া থাকলে ব্যাংক গ্রাহকের সঙ্গে সমঝোতা করে পুনঃতফসিল করতে পারে, কিন্তু এককালীন টাকা আদায়ের চাপ দেওয়া যাবে না।
পরিস্থিতি আরও জটিল হয় ২৬ অক্টোবর। নিজের বাসার কাছে রূপালী ব্যাংকের একটি শাখা থেকে জমা টাকার অর্ধেক তুলতে গেলে চেক প্রত্যাখ্যাত হয়। পরে জানা যায়, তাঁর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ বা অবরুদ্ধ করা হয়েছে। শাখার সহকারী মহাব্যবস্থাপক জানান, ‘ওপরের নির্দেশে’ হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। অথচ সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করতে পারবে না। এটি স্পষ্টভাবে নিয়মবহির্ভূত।
মফিজ উদ্দীন আহমেদ জানান, পরবর্তীতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, নিয়মিত কিস্তি পরিশোধকারী গ্রাহককে কেন এমন অযাচিত চাপ দেওয়া হলো।
তিনি অর্থ বিভাগকে বলেন, যেখানে সাধারণ ঋণের সুদের হার ১২ শতাংশের ওপরে গিয়ে অনেক বেসরকারি ব্যাংক ভালো গ্রাহকের পেছনে ছুটছে, সেখানে ৫০ শতাংশ খেলাপি ঋণ নিয়ে দেউলিয়া হওয়ার পথে থাকা রূপালী ব্যাংক কেন নিয়মিত কিস্তি পরিশোধকারী গ্রাহককে তাড়িয়ে দিতে চাইছে, তা তাঁর কাছে বোধগম্য নয়। তাঁর ভাষায়, ঘটনাটি রূপালী ব্যাংকের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অপেশাদারত্ব ও অদক্ষতার প্রতিফলন। মফিজ উদ্দীন বলেন, ‘অর্থ বিভাগ ইতিমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে। রূপালী ব্যাংকও দুঃখ প্রকাশ করেছে। এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না।’
অন্য ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধেও অভিযোগ:
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শুধু রূপালী ব্যাংকই নয়। সরকারি কর্মচারীদের গৃহঋণ কার্যক্রমে যুক্ত অনেক ব্যাংকের বিরুদ্ধেও গ্রাহকরা বিভিন্ন ধরনের হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও এমন অভিজ্ঞতার কথা ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
গৃহঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ। সরকার ৫ শতাংশ ভর্তুকি দেয়, গ্রাহক বহন করেন মাত্র ৪ শতাংশ। কিন্তু অন্যান্য সাধারণ ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো এখন গৃহঋণ দিতে আগ্রহী নয়। ফলে নানা অজুহাত দিয়ে গ্রাহককে হয়রানি করা হচ্ছে।
অর্থ বিভাগ নির্দেশনায় ১২ ব্যাংককে হুঁশিয়ারি:
অর্থ বিভাগ ১১ নভেম্বর গৃহনির্মাণ ঋণ কার্যক্রমে যুক্ত ১২টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের চিঠি পাঠিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল), বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি), ব্র্যাক ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক ও ডিবিএইচ ফাইন্যান্স।
চিঠিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, গ্রাহকের সম্মতি ছাড়া ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে না। অবসরের পর কিস্তি বকেয়া থাকলে সুদের হার অপরিবর্তিত রেখে আলোচনা সাপেক্ষে সমাধান করতে হবে। কোনো অস্পষ্টতা থাকলে তা পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করতে হবে। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ঋণগ্রহীতাদের ফ্ল্যাট বা বাড়ি দলিলমূলে বন্ধক থাকে, তাই এ ঋণ সম্পূর্ণ নিরাপদ। ফলে সরকারি কর্মচারীরা অবসরে গেলে তাদের ওপর ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আংশিক বা সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধের চাপ দেওয়াটা অনভিপ্রেত।
জানতে চাইলে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা এহতেশামুজ্জামান বলেন, এমডি তাঁকে জানিয়েছেন, ঘটনাটি ‘মিটমাট হয়ে গেছে’।
সরকারি কর্মচারীদের গৃহঋণ ও ভর্তুকির তথ্য:
‘সরকারি কর্মচারীদের জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে গৃহনির্মাণ ঋণ প্রদান নীতিমালা-২০১৮’ প্রজ্ঞাপন জারি হয় ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই। এতে সর্বোচ্চ ঋণসীমা ৭৫ লাখ এবং সর্বনিম্ন ২০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। নীতিমালাটি পরে কয়েক দফা সংশোধন করা হয়েছে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে চলতি ২০২৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৮ হাজার ১৯৪ জন সরকারি কর্মচারীর নামে ঋণ মঞ্জুর হয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ১৬৪ জন সাময়িক মঞ্জুরি এবং ৪ হাজার ৩০ জন চূড়ান্ত মঞ্জুরি পেয়েছেন। চূড়ান্ত মঞ্জুরি পাওয়া ব্যক্তিরা ভর্তুকি পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত কোষাগার থেকে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ভর্তুকি হিসেবে দেওয়া হয়েছে ১৮৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।

