বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘ ১৪ বছরের পর অবশেষে নিজস্ব কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারে ফিরছে। এর মাধ্যমে কেবল প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, দেশের আর্থিক সাইবার সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের এক বড় দিক উন্মোচিত হচ্ছে।
২০০১ সালের পর এই কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার কোর সিস্টেমে বিদেশী সফটওয়্যারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। ২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ভারতের টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেস (টিসিএস) বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩০ তলা অফিসে স্থায়ীভাবে উপস্থিত ছিল। তাদের হাতে ছিল:
-
সার্ভার অপারেশন
-
ডাটাবেজ অ্যাডমিন পোর্ট
-
এনক্রিপ্টেড ফাইল সিস্টেম
-
সিস্টেম পাসওয়ার্ড লেভেলের কনফিগারেশন
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংবেদনশীল তথ্য বিদেশী টেকনিশিয়নের হাতে থাকা বিষয়টি দীর্ঘদিন বিতর্কিত ছিল। একাধিক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, ‘কত তথ্য বাহিরে গিয়েছে, তা কেউ জানে না।’ ২০১৬ সালের রিজার্ভ চুরির তদন্তেও টিসিএস সিস্টেমের নিরাপত্তা দুর্বলতার বিষয় উঠে আসে।
কেন এতদিন পরিবর্তন হয়নি?
বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, বিষয়টি দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রাখা হয়েছিল নানা কারণে:
-
কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিদেশী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে লবিং করতেন
-
প্রকল্প পরিবর্তন বিলম্বিত করতে ফাইল ট্র্যাপ ও সিদ্ধান্তগত বাধা তৈরি হতো
-
লাইসেন্স নবায়ন ও পরামর্শক নিয়োগে অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা পান
-
প্রযুক্তিগত স্যাবোটাজের অভিযোগও ওঠে
যেখানে ব্যাংক ইতিমধ্যেই ২০ বছরের মধ্যে ১০০টির বেশি সফটওয়্যার নিজস্বভাবে তৈরি করেছে, সেখানে কোর সিস্টেমে স্বনির্ভর হতে ১৪ বছর লাগার ঘটনা আরও সন্দেহজনক হয়ে ওঠে।
বিদেশী সফটওয়্যারের খরচ: হাজার কোটি টাকার প্রভাব
২০১১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক টিসিএস-কে দিয়েছে এক হাজার কোটিরও বেশি টাকা—সার্ভিস চার্জ, লাইসেন্স নবায়ন, পরামর্শক খরচ ও সাপোর্ট ফি মিলিয়ে। অভিযোগ উঠেছে, ‘এই খরচের বড় অংশই ছিল অদৃশ্য লুটপাটের জানালা।’
কোর সফটওয়্যার পরিবর্তনের সাফল্য
আইসিটি-১ বিভাগের তরুণ প্রযুক্তিবিদরা বছরের পর বছর ধীরে ধীরে নিজস্ব কোর সফটওয়্যার ‘বিসিবিআইসিএস’ তৈরি করছেন। ২০২৫ সালে প্রকল্পের সব মডিউল পাস, নিরাপত্তা যাচাই সম্পন্ন, এবং সমান্তরাল রানের মাধ্যমে কার্যক্রম স্থিতিশীল হয়েছে। ৮ ডিসেম্বর সভায় নতুন সফটওয়্যারকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে।
এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যারা পরিবর্তন আটকাতে চেয়েছিল, তারা এবার ব্যর্থ হয়েছেন।’
নতুন সফটওয়্যার চালু হলে কী হবে?
- ডাটা সার্বভৌমত্ব ফিরে আসবে: সংবেদনশীল তথ্য বিদেশী হাত থেকে মুক্ত।
- খরচ কমবে: বিদেশী সাপোর্ট ও লাইসেন্স খরচ প্রায় ৭০ শতাংশ কমবে।
- সাইবার ঝুঁকি শূন্যের কোঠায়: নিজস্ব কোড মানে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।
- দ্রুত নীতি পরিবর্তন ও কাস্টমাইজেশন: আর ভারত থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
- নিরাপদ রিয়েল-টাইম সার্ভিলেন্স ও ফরেন রিজার্ভ অ্যাকাউন্টিং: ২০১৬ সালের মতো সাইবার ঘটনার ঝুঁকি কমবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোর সিস্টেম স্বাধীন হওয়া মানে আর্থিক তথ্য, নীতিনির্ধারণ ও ডিজিটাল টাকার রোডম্যাপে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এক সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এটি দেশের আর্থিক স্বাধীনতার দ্বিতীয় ঘোষণা।’
‘স্বাধীনতা দিবস’ আসছে
১৮ ডিসেম্বর, পুরনো টিসিএস সফটওয়্যার বন্ধ হওয়ার সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নতুন প্রযুক্তিগত স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করবে। ১৪ বছরের ভুল সিদ্ধান্ত, বিদেশী লবিং ও নিরাপত্তাজনিত অবহেলার দায় এখনও অমীমাংসিত থাকলেও, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবশেষে নিজস্ব সক্ষমতায় দাঁড়াচ্ছে। ব্যাংক জানাচ্ছে, ‘আমরা আর কাউকে আমাদের ডাটা ভল্টের চাবি দেবো না।’

