বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং খাত এখন অভূতপূর্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বড় আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে রিটেইল ব্যাংকিং থেকে সরে এসে ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট ও প্রাইভেট ব্যাংকিংয়ের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিটি, এইচএসবিসি-এর মতো বড় ব্যাংকগুলো বিভিন্ন দেশে সাধারণ গ্রাহক-ব্যাংকিং থেকে বেরিয়ে এসে হংকং, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী কেন্দ্রে তাদের সেবা কেন্দ্রীভূত করেছে।
এখন তারা প্রধানত সম্পদের শীর্ষস্তরের ক্লায়েন্টদের দিকে নজর দিচ্ছে। এই গ্রাহকদের জন্য তারা ওয়েলথ ও বিনিয়োগ পরামর্শ, সম্পদ উত্তরাধিকার পরিকল্পনা ইত্যাদি সেবা সরবরাহ করছে। এসব সেবা প্রদান করা হচ্ছে অভিজ্ঞ ব্যাংকারদের মাধ্যমে, পাশাপাশি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে। এছাড়া, তারা অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্ট্রাকচার্ড ইনভেস্টমেন্ট প্রোডাক্টের বিক্রেতা হিসেবে কাজ করে উচ্চ ফি আয়ও করছে।
যদিও ব্যাংকগুলোর কাছে গ্রাহকদের ব্যয়ধারার বিশাল তথ্য থাকে, কিন্তু তারা খুব কমই এই তথ্য ব্যবহার করে গ্রাহকের জন্য কাস্টমাইজড সেবা তৈরি করে। এটি একটি বড় সুযোগ, যা ব্যাংকগুলোকে পার্থক্য তৈরি করতে পারে, যদি তারা গ্রাহকের ব্যয় অভ্যাস অনুযায়ী সেবা ব্যক্তিগতকরণ করতে পারে।
বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলো এখন ডিজিটাল কারেন্সির দিকেও এগোচ্ছে। অধিকাংশ দেশে দেশীয় লেনদেন ইতিমধ্যেই আংশিক বা সম্পূর্ণ ডিজিটাল। কিন্তু ক্রস-বর্ডার পেমেন্ট এখনো বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ ভিন্ন দেশগুলোর নিয়মকানুন এবং সময় অঞ্চলের পার্থক্য এতে প্রভাব ফেলে।
টোকেনাইজড মানি—চলতি বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল কারেন্সি, স্টেবল কয়েন বা ব্যাংক-ইস্যু করা টোকেনাইজড ডিপোজিট—এই ক্ষেত্রটিকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে। বাংলাদেশে প্রবাসী রেমিট্যান্স দ্রুত আনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও স্থানীয় ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক সমকক্ষদের সঙ্গে কাজ করতে পারে।
সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত “জিসর” প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং চীনের ব্যাংকগুলো একসাথে ক্রস-বর্ডার পেমেন্ট সম্পন্ন করেছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্বারা ইস্যু করা ডিজিটাল কারেন্সি ব্যবহার করে। যেহেতু সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশের জন্য অন্যতম প্রধান রেমিট্যান্স উৎস, তাই এটি আমাদের জন্য বড় সুযোগ। বিভিন্ন দেশের পেমেন্ট সিস্টেমকে ইন্টারলিঙ্ক করলে যেমন সংযুক্ত আরব-চীন উদাহরণে দেখা গেছে, ক্রস-বর্ডার লেনদেন দ্রুত ও সহজ হতে পারে।
বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলো জেনারেটিভ এআই এবং এজেন্টিক এআই-তে বিনিয়োগ করছে। দীর্ঘ সময় ধরে প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের পরও অনেক ব্যাংকিং প্রক্রিয়া এখনও হাতে করা হচ্ছে। যেমন: ক্লায়েন্ট অনবোর্ডিং, এএমএল বা কেওয়াইসি চেক।
এআই ব্যবহার করে ব্যাংক গ্রাহকের তথ্য অটো-ফিল করতে পারে, ক্লায়েন্টরা নিজেদের ডিভাইস থেকে বাকিটা সম্পন্ন করতে পারে। এনআইডি ও এনবিআর সার্ভারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করলে রিয়েল-টাইম পরিচয় যাচাই এবং ট্যাক্স ডকুমেন্ট সংগ্রহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে করা সম্ভব।
ক্রেডিট অ্যাপ্রাইজাল এবং পোর্টফোলিও রিভিউও এখনও বেশি হাতে করা হচ্ছে। এআই ব্যবহার করে ব্যাংকরা রিটেইল ও ছোট ব্যবসার গ্রাহকের জন্য ক্রেডিট স্কোরিং অটোমেট করতে পারে। মারাত্মক অর্থনৈতিক বা ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্টের সময় তৎপরতার বদলে, এআই আগেভাগে সতর্ক সংকেত দিতে পারে।
সেলস এবং ক্লায়েন্ট রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্টেও এআই নতুন দিগন্ত খুলতে পারে। শুধু সিআরএমে গ্রাহকের তথ্য রাখার বদলে, এআই ক্রস-সেলিং সুযোগ চিহ্নিত করতে এবং সম্ভাব্য প্রোসপেক্টিভ ক্লায়েন্ট হাইলাইট করতে সাহায্য করবে।
ভবিষ্যতে ক্লায়েন্টরা নিজের এআই এজেন্ট ব্যবহার করে ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করবে, আর বিনিয়োগ ও আর্থিক সিদ্ধান্ত নেবে। যারা এখনই এই বৈশ্বিক ধারা অনুসরণ করবে এবং বিনিয়োগ করবে, তারা আগামী দশকে বাজারে নেতৃত্ব দেবে।
বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলো রিটেইল ব্যাংকিং থেকে সরছে, ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট, ডিজিটাল কারেন্সি ও এআই প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশও এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে, বিশেষ করে রেমিট্যান্স ও ডিজিটাল লেনদেনকে আরও সহজ করার মাধ্যমে। যারা এখনই নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করবে, তারা আগামী দশকে ব্যাংকিং জগতে নেতৃত্ব দেবে।
সূত্র: ডেইলি স্টার

