অতীতেও সংসদে মন্দ ঋণগ্রহীতাদের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। সেই সময়কার অর্থমন্ত্রীকে পরবর্তী নির্বাচনে দলের হারের জন্য দায়ী করা হয়েছিল। অর্থঋণ আদালত কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি। কিছু ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিম্ন আদালতে জিতে হলেও উচ্চ আদালতে সেই জয় ধরে রাখতে পারেনি। এমন পরিস্থিতি হয়েছিল যখন বৃহৎ ও পরিচিত ঋণখেলাপিদের সমর্থন ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপদে নিয়োগ করা সম্ভব হতো না।
হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারির পর নামি-দামি সাবেক ডেপুটি গভর্নর এবং গভর্নরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বললেও বাস্তবে কিছু হয়নি। পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সফল হননি। ভারতের উদাহরণেও দেখা যায়, বড় গ্রুপের ঋণ অনুমোদনে রাজনৈতিক প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যদিও ইনসলভেন্সি অ্যান্ড ব্যাংকরাপসি কোড (আইবিসি) মন্দ ঋণ কমাতে কিছুটা সাহায্য করেছে, ক্ষত বা সংস্কৃতি এখনও রয়েছে।
আমাদের অনেক শিক্ষক সৎ ও আবেগী মানুষ। তবে সমস্যার সমাধানের প্রায়ই সঠিক উপায় তারা জানেন না। কিছু অর্থনীতিবিদ শুধুমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্রের কথা পুনরাবৃত্তি করছেন, কিন্তু নিজস্ব জ্ঞান বা বিশ্লেষণ দেখাতে পারছেন না। সবাই রঘুরাম রাজন হতে পারেন না, তবে এ বিষয়ে একটি ছোট নিবন্ধ বা বই পড়ার চেষ্টা তো করা যেতেই পারে। তাহলে তাদের সঙ্গে দুষ্টু রাজনৈতিক নেতা বা অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তার পার্থক্য কোথায়?
ক্রমবর্ধমান মন্দ ঋণ কেবল কিছু ব্যক্তির দায় নয়। স্বজনতোষী পুঁজিবাদ, রাজনৈতিক আনুকূল্য, বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা, আইনি সীমাবদ্ধতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারির অভাব, ব্যাংকের পর্ষদ ও ঝুঁকি কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা—all মিলে সমস্যাকে আরও গভীরে প্রবিষ্ট করেছে।
এস আলম বা বেক্সিমকো নয়, ৫০ থেকে ৩০০০ কোটি টাকার অনেক মন্দ ঋণ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন জাগেছে—কীভাবে এত টাকা এত সহজে ব্যাংক থেকে বের হলো? বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর পরিকল্পনা নেই, হিসাব ব্যবস্থাপক নেই। কেউ কেউ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি বা অর্থ পাচারকারী থাকলেও পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। যেসব ব্যাংক ঋণখেলাপির অভিযোগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হন, তাদের কর্মকর্তাদের দায়মুক্ত করা কি সম্ভব?
মূল্যস্ফীতি কমানোর নামে উচ্চ সুদের হার বা হঠাৎ ৫০% অবমূল্যায়নের ফলে যাদের ঋণ মন্দ হয়েছে, তাদের কী বলা যাবে? গত ১৬ বছরে রাজনৈতিক নিগ্রহের শিকার ব্যবসায়ীদের কথা কি শুনবেন না? ব্যবসায়ীরা কেন রাজনীতিতে জড়াবেন, রাজনীতিবিদ কেন চাঁদা নেবেন—এই আলোচনাকেও পাশ কাটানো যায় না। সব মন্দ ঋণ একটানা লুকিয়ে রাখার কারণে তা এখন পাহাড়সম হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু সেটাই পুরো সত্য নয়।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নতুন কোনো সমস্যা নয়। বহু বছর ধরে মন্দ ঋণ বা নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষয় করেছে। একসময় এটি ছিল মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সমস্যা। পরে তা বেসরকারি খাতেও ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে এটি একটি অদৃশ্য কিন্তু বিস্তৃত ‘সংস্কৃতি’তে পরিণত হয়েছে—যেখানে কেউ ঋণখেলাপি হলে তা বড় ঘটনা হিসেবে গণ্য হয় না। এই মানসিকতা ও দীর্ঘমেয়াদি দুর্বল শাসন ব্যবস্থা আজ আমাদের ব্যাংক খাতকে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে।
গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ব্যাংকগুলোতে লুকানো ঋণের প্রকৃত অবস্থা ধীরে ধীরে সামনে এসেছে। মানুষ ভেবেছিল সর্বোচ্চ ১২ শতাংশই হবে। কিন্তু এক বছরের কিছু বেশি ব্যবধানে হার প্রায় তিন গুণ বেড়ে ৩০–৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ দেশের ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৩ ভাগের ১ ভাগ এখন খেলাপি। যে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর দেশের ব্যবসা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নির্ভর করে, সেই ব্যবস্থার এত বড় অংশ অচল হওয়া গভীর উদ্বেগের বিষয়।
এ উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায়ই নয়, সমগ্র এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খেলাপি ঋণের দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষে। অন্যদিকে ভারত, ভুটান, মালদ্বীপের মতো দেশ এই হার নাটকীয়ভাবে কমাতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের খেলাপি ঋণ নেমে এসেছে মাত্র ১.৭ শতাংশে, যেখানে বাংলাদেশ প্রায় ২০ গুণ উঁচু অবস্থানে। এই তুলনা দেখায়—সমস্যা কেবল বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কারণে নয়; আমাদের নীতিমালা, তদারকি ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বাস্তবতা মূল কারণ। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে।
প্রথমত, দীর্ঘদিন ধরে ঋণ প্রদান ও ব্যবস্থাপনায় পেশাগত মানদণ্ডের অভাব চোখে পড়েছে। অনেক ঋণ ব্যবসায়িক সক্ষমতার ভিত্তিতে নয়, পরিচয়, প্রভাব বা রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার কারণে দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প ব্যর্থ হলে দায় ব্যাংকের ওপর পড়েছে, প্রভাবশালীর নয়।
দ্বিতীয়ত, ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ বা রিশিডিউলিংয়ের শিথিল নীতিমালা প্রকৃত খেলাপিকে লুকিয়ে রাখার সুযোগ দিয়েছে। কিছু ব্যাংক বছরের পর বছর একই ঋণ পুনর্গঠন করে দেখিয়েছে যেন সব ঠিক আছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা বা নির্বাচনী বছরের আগে আরও উদার রিশিডিউলিং বাস্তবতা আড়াল করেছে।
তৃতীয়ত, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দা ও চাহিদা সংকোচন ব্যবসায়িক ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়িয়েছে। সত্যিই সক্ষম উদ্যোক্তারাও সমস্যায় পড়েছেন। অতীতে প্রভাবভিত্তিক ঋণ এখন ‘পৃষ্ঠপোষকতা’হীন হওয়ায় দ্রুত মন্দ ঋণে পরিণত হচ্ছে।
চতুর্থত, ব্যাংকগুলোর দুর্বল সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সমস্যা আরও গভীর করেছে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ক্রেডিট রেটিং, লোন ক্লাসিফিকেশন বা প্রভিশনিং দীর্ঘদিন নিশ্চিত করা যায়নি। ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে স্বজনপ্রীতি, স্বার্থের সংঘাত ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনা বারবার প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকও কঠোর নীতির পরিবর্তে অনেক সময় সমঝোতিপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের চাপ, ব্যাংক মালিকদের প্রভাব বা সিস্টেমিক রিস্ক এড়ানোর অজুহাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে বাস্তবতা হলো, কঠোরতা না থাকলে ঋণখেলাপির সংস্কৃতি শক্তিশালী হয় এবং সুশাসন দুর্বল হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী—২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা মোট ঋণের প্রায় ৩৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ এত বড় হার দেখেনি। তুলনায়, ভুটান খেলাপি ঋণ ১১ থেকে ৩ শতাংশে নামিয়েছে, আর আমাদের ঋণ ১০ থেকে ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—এ পরিমাণ খেলাপি ঋণ ব্যাংকের মূলধন, তারল্য ও আস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে ঋণপ্রবাহ কমবে, শিল্প-কারখানার কর্মসংস্থান স্থবির হবে, আমদানি-ব্যবসায় সংকট দেখা দেবে। বিদ্যমান ব্যবসা সম্প্রসারণের সাহস কমে যাবে, নতুন উদ্যোক্তারা আগ্রহ হারাবেন। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীর দৃষ্টিতেও বাংলাদেশের ঝুঁকি বাড়বে, যা ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে মন্দ ঋণের সমস্যা বড় হলেও সমাধান অসম্ভব নয়। তবে এর জন্য প্রয়োজন কঠোরতা, পেশাদারিত্ব ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণ বিতরণে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে দক্ষতা, নৈতিকতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি উভয় ব্যাংকে ‘ক্রেডিট কালচার’ পুনর্গঠন প্রয়োজন।
খেলাপিদের জন্য অযৌক্তিক পুনঃতফসিল সুবিধা বন্ধ করা একান্ত প্রয়োজন। ঋণ পুনর্গঠন হবে কেবল সেই উদ্যোক্তার জন্য, যিনি সত্যিই টিকে থাকতে পারেন। অর্থাৎ যাদের ব্যবসায় বাস্তব সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশকে ‘ঋণখেলাপির অভয়ারণ্য’ হিসেবে ভাবার সংস্কৃতি ভাঙতে হবে।
লুকানো খেলাপি ঋণ শনাক্ত করতে আন্তর্জাতিক মানের অডিট এবং সুপরিকল্পিত স্ট্রেস টেস্ট অপরিহার্য। ব্যালান্স শিটে স্বচ্ছতা না আনলে সমস্যা আরও বড় হবে। পাশাপাশি, রাজনৈতিক প্রভাবাধীন ঋণ বিতরণে জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ করতে হবে। অতীতের রাজনৈতিক ব্যবসায়িক সম্পর্ক যা ক্রেডিট বাজারকে অস্বাভাবিকভাবে বিকৃত করেছে, তা ভেঙে দেওয়া এখন সময়ের দাবি। ভাইবোন, আত্মীয় বা মালিক পরিবৃত্তের প্রতি বিশেষ সুবিধা প্রদানে ব্যাংক গভর্ন্যান্সে কঠোর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। আইন ও নিয়মে ছাড় দিলে ব্যাংক খাত আরও বিপদে পড়বে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—ভালো, সক্ষম ও সৎ উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় ফিরিয়ে আনা। শুধুমাত্র কঠোরতা নয়, সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেই ব্যাংক খাতকে টেকসই করা সম্ভব। সঠিক উদ্যোক্তাদের জন্য নীতি সমর্থন, বাজারে আস্থা, কর সহজীকরণ এবং দ্রুত ঋণ মঞ্জুরির সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো ব্যাংক ব্যবস্থা। যেখানে তিন ভাগের এক ভাগ ঋণ অচল, সেখানে মেরুদণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক পরিবর্তন ও বাজার বাস্তবতা মিলিয়ে এখন ‘সত্যিকারের সংস্কারের’ সময়। এই মুহূর্তে সাহসী পদক্ষেপ, স্বচ্ছতা ও নেতৃত্বের সমন্বয় ছাড়া খেলাপি ঋণ কেবল আর্থিক নয়, সামাজিক ও সমষ্টিগত অর্থনৈতিক ঝুঁকিকেও বহুগুণ বাড়াবে।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।

