বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদেই ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২০২৪ সালের জুনে তখনকার সরকারে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। এটি ব্যাংক খাতের মোট বিতরণকৃত ঋণের ১২.৫৬ শতাংশ। তবে ওই হিসাব নিয়েও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন ছিল।
২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর খেলাপি ঋণ দ্রুত বাড়তে থাকে। কারণ, আওয়ামী লীগের সময় নানা সুবিধা ও ব্যবস্থার মাধ্যমে আড়াল করা ঋণগুলো প্রকৃত চিত্রে আসে। ফলে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণও হু হু করে বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এটি মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ।
তবে সব ব্যাংকের পরিস্থিতি একই নয়। দেশীয় ৫২ ব্যাংকের মধ্যে ৩০টির খেলাপি ঋণ ২০ শতাংশের নিচে। ৬টির খেলাপি ঋণ ২১ থেকে ৪৯ শতাংশের মধ্যে। ১৬টির মোট ঋণের ৫০ থেকে ৯৯ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে, যা পুরো খাতের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। খেলাপি ঋণের এই পরিস্থিতির মধ্যেও ভালো অবস্থানে রয়েছে ১৭টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের কম। এর মধ্যে ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ মাত্র ৫ শতাংশের নিচে। খেলাপি কম থাকা এই ব্যাংকগুলো মুনাফা, করপোরেট উত্তম চর্চা এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় শীর্ষে অবস্থান করছে। তাই এই ব্যাংকগুলো দেশের ব্যাংক খাতের জন্য মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কম খেলাপি ঋণের ব্যাংকগুলো:
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, যে ১৭ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে, সেগুলো হলো যথাক্রমে সিটিজেন্স ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল, ব্র্যাক ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী, এনসিসি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংক। এর মধ্যে প্রথম ছয়টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে।
ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি তারেক রেফাত উল্লাহ খান জানান, “আমাদের ঋণ ব্যবস্থাপনা বিভাগ শক্তিশালী। গ্রাহক সমস্যায় পড়লে আমরা পাশে থাকি। এসব উদ্যোগ খেলাপি ঋণ কম রাখতে সাহায্য করছে।” সবচেয়ে কম খেলাপি ঋণের শীর্ষে নতুন প্রজন্মের সিটিজেন্স ব্যাংক। নতুন ব্যাংক হওয়ায় এর ঋণও কম, খেলাপি হার মাত্র ১.৭৪ শতাংশ। এরপর আসে ইস্টার্ন ব্যাংক ৩.০৯ শতাংশ, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ৩.২৪ শতাংশ, ব্র্যাক ব্যাংক ৩.৫৮ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংক ৪.০১ শতাংশ ও সিটি ব্যাংক ৪.৭৬ শতাংশ।
সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বলেন, “ব্যাংকের ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং ঋণ অনুমোদন স্বাধীন। ঋণের ৩০ শতাংশ করপোরেট খাতের। বাকিটা ভোক্তা ঋণ, সিএমএসএমই ও ক্রেডিট কার্ডের। বিকেন্দ্রীকরণ বেশি হওয়ায় খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে।”
অন্যান্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণ:
| ব্যাংকের নাম | খেলাপি ঋণের হার (%) |
|---|---|
| মিডল্যান্ড ব্যাংক | ৫.৪০% |
| পূবালী ব্যাংক | ৫.৫০% |
| মেঘনা ব্যাংক | ৬.১১% |
| মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক | ৬.৮৩% |
| কমিউনিটি ব্যাংক | ৭.০৭% |
| শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক | ৭.৬৭% |
| এনসিসি ব্যাংক | ৮.৩১% |
| ঢাকা ব্যাংক | ৮.৪৪% |
| উত্তরা ব্যাংক | ৮.৯১% |
| ট্রাস্ট ব্যাংক | ৮.৯৫% |
| যমুনা ব্যাংক | ৯.০৬% |
প্রাইম ব্যাংকের ডিএমডি জিয়াউর রহমান জানান, “চার-পাঁচ বছর ধরে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩.৫–৪ শতাংশের মধ্যে ছিল। সাময়িকভাবে এটি ৪.২২ শতাংশে ওঠে। বর্তমানে কমে ৩.৮ শতাংশে নেমেছে। আমরা আশা করি ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ ৩ শতাংশের নিচে নামানো সম্ভব হবে। পরিকল্পিত রিকভারি, মনিটরিং ও রাইট অফ কার্যক্রমের মাধ্যমে নতুন ঋণ খারাপ না হওয়া নিশ্চিত করা হচ্ছে।” এই ব্যাংকগুলো তাদের কার্যকর ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের কারণে দেশের ব্যাংক খাতের জন্য মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের ব্যাংকগুলো:
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতে। পাশাপাশি কিছু প্রচলিত ধারার ব্যাংকও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে। এতে এই ব্যাংকগুলোর অধিকাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে।
সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের তালিকায় শীর্ষে ইউনিয়ন ব্যাংক, যেখানে খেলাপি ঋণের হার ৯৬.৬৪ শতাংশ। এরপর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৯৬.২০ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ৯৫.৭০ শতাংশ, পদ্মা ব্যাংক ৯৪.১৭ শতাংশ এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংক ৯১.৩৮ শতাংশ।
অন্য ব্যাংকের হারও উদ্বেগজনক। এবি ব্যাংক ৮৪.০৪ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংক ৭৫.৪৬ শতাংশ, জনতা ব্যাংক ৭৩.১৮ শতাংশ এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ৭১.১১ শতাংশ। বেসিক ব্যাংক ৭০.৫৯ শতাংশ এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ৭০.১৭ শতাংশ। আইএফআইসি ব্যাংক ৬০.৬৩ শতাংশ, ইসলামী ব্যাংক ৫৮.২৪ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংক ৫৬.৮৬ শতাংশ খেলাপি ঋণ ভোগ করছে।
খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংকগুলো একীভূত করে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ছিল বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের নিয়ন্ত্রণে। বাকি চারটি ব্যাংক—সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংক—চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের কর্ণধার ও ব্যবসায়ী সাইফুল আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল। দুইজনই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, “ব্যাংকগুলোকে ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশের কথা বলা হয়েছে। এতে খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। আশা করি ভবিষ্যতে হার ধীরে ধীরে কমবে। ইতিমধ্যে নানা উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বাড়লেও অনেক ব্যাংক ভালো অবস্থানে রয়েছে।”

