চলতি সপ্তাহেই মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য একটি খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করে অংশীজনদের মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রবর্তিত “সামাজিক ব্যবসার” ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বিশেষায়িত একটি ‘মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ব্যাংকটি পরিচালনার খসড়া অধ্যাদেশও তৈরি করা হয়েছে। প্রস্তাবিত ব্যাংকটি প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এড়িয়ে ক্ষুদ্র ও উদীয়মান উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ প্রদান করবে। এর মূল বৈশিষ্ট্য হলো—ঋণগ্রহীতারাই ব্যাংকের প্রধান শেয়ারধারী হবেন। এছাড়া, ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বায়ত্বশাসিতভাবে পরিচালিত হবে।
নতুন নিয়ন্ত্রক কাঠামো:
চলতি সপ্তাহেই মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য একটি খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করে অংশীজনদের মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। খসড়া অনুযায়ী, ব্যাংকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো সব ধরণের আর্থিক সেবা প্রদান করবে। তবে লাইসেন্সিং, নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির দায়িত্বে থাকবে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিবর্তে, ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা—মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) ব্যাংকটির লাইসেন্স এবং তদারকির দায়িত্ব পালন করবে।
এছাড়া, কোম্পানি অবসায়ন সংক্রান্ত প্রক্রিয়াতেও ব্যাংককে কোম্পানি আইন ও অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংকিং বিধিবিধান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এটি দেশের প্রচলিত আর্থিক কাঠামোয় একটি বড় ধরনের ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সামাজিক ব্যবসার নীতিতে পরিচালিত হবে:
গত ১৭ মে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশের তরুণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে ‘ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক’ স্থাপনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি জামানতের বদলে “আস্থা ও বিশ্বাসের” ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। প্রধান উপদেষ্টার এই নির্দেশনার পর সরকার উদ্যোগটি গ্রহণ করেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকিং সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে সামাজিক ব্যবসার ধারণা প্রবেশের জন্য আইনী ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, “এর মূল দর্শন হলো—ব্যাংকটি সামাজিক ব্যবসা হিসেবে পরিচালিত হবে। বিনিয়োগকারী বা মূলধনের যোগানদাতারা তাদের বিনিয়োগের অতিরিক্ত মুনাফা নিতে পারবেন না। যেকোনো অতিরিক্ত মুনাফা পুনঃবিনিয়োগ করতে হবে। এর মাধ্যমে প্রচলিত করপোরেট ও সর্বোচ্চ মুনাফাভিত্তিক মডেলের বিকল্প কাঠামো তৈরি হবে।”
কার্যপরিধি ও মূলধন কাঠামো নির্ধারণ: খসড়া অধ্যাদেশে প্রস্তাবিত মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংকের বহুমুখী কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—
- ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সরবরাহ: ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ।
- ভৌত সম্পদ সরবরাহ: শিল্প ও কৃষিযন্ত্র, গবাদিপশু এবং কাঁচামাল ঋণের মাধ্যমে সরবরাহ।
- সমন্বিত সহায়তা: কারিগরি, প্রশাসনিক ও বিপণন পরামর্শের পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের জন্য বীমা সুবিধা।
- সঞ্চয় ব্যবস্থাপনা: ঋণগ্রহীতা ও সাধারণ জনগণের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ।
প্রস্তাবিত ব্যাংকটির অনুমোদিত মূলধন হবে ৩০০ কোটি টাকা, যা ১০০ টাকা মূল্যমানের তিন কোটি শেয়ারে বিভক্ত থাকবে। প্রারম্ভিক পরিশোধিত মূলধন নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। ব্যাংক পরিচালনার জন্য সাত সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ থাকবে। এর মধ্যে ঋণগ্রহীতা শেয়ারহোল্ডার মনোনিত তিনজন পরিচালক এবং অন্যান্য শেয়ারহোল্ডার মনোনিত তিনজন পরিচালক থাকবেন।
উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা:
তবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত পরিচালক (গবেষণা) তৌফিকুল ইসলাম খান এই উদ্যোগ নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, মাইক্রোক্রেডিট ব্যাংক যে ধরণের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তার অনেকগুলোই ইতিমধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকসহ এমআরএ লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো করতে সক্ষম।
তৌফিকুল ইসলাম খান মনে করেন, নতুন ব্যাংক গঠনের পরিবর্তে বিদ্যমান মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিকে আরও শক্তিশালী করে ধাপে ধাপে এসব প্রতিষ্ঠানের সেবা বিস্তৃত করাই বেশি যৌক্তিক। তিনি আরও বলেন, দেশে মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের জন্য ইতিমধ্যেই অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই অবস্থায় নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলে বাজারে চরম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হতে পারে।
তিনি উল্লেখ করেন, ”সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আছে। এই সরকার অধ্যাদেশ জারি করলেও নবগঠিত ব্যাংকটি রাজনৈতিক সরকারের মেয়াদে কার্যক্রম শুরু করবে। তাই এই সময়ে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি নেওয়াও প্রয়োজন।”
মাইক্রোক্রেডিট খাতের বর্তমান চিত্র:
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) গত জুনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানায়, দেশে বর্তমানে ৭২৪টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠান মোট ৪ কোটি ১৬ লাখ সদস্যকে সেবা দিচ্ছে, যার মধ্যে ৩ কোটি ২২ লাখ ঋণগ্রহীতা। এটি দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে বড় অবদান রেখেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ২ লাখ ২৩ হাজারের বেশি কর্মী কাজ করছেন এবং দেশে মোট ২৬ হাজার ৭১টি শাখা রয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।
২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণ স্থিতি ছিল ১ লাখ ৫৯ হাজার ৪১০ কোটি টাকা এবং সঞ্চয় ছিল ৬৮ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ঋণ বিতরণ হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা, যার প্রায় ৫০ শতাংশ কৃষিখাতে প্রান্তিক পর্যায়ে বিতরণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর উল্লেখ করেছেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো মাইক্রোফাইন্যান্স খাতে ৫ লাখ ৬০ হাজার সদস্য ও ৪ লাখ ঋণগ্রহীতাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এসব ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবস্থাপিত ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা, সঞ্চয় ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা এবং মোট ঋণ বিতরণ ৫ হাজার ৮০২ কোটি টাকা।

