মাত্র দুই সপ্তাহে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। নির্বাচনসংক্রান্ত ব্যয় এবং পাঁচটি ব্যাংকের মূলধন সহায়তায় অর্থ ছাড় এর প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে সরকারের ব্যাংকঋণ ছিল খুবই সীমিত। ওই সময়ে উন্নয়ন ব্যয় কার্যত স্থবির থাকায় সরকারের অর্থের চাহিদাও কম ছিল। তবে পরবর্তী মাত্র দুই সপ্তাহে পরিস্থিতিতে বড় পরিবর্তন আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা যায়, একই অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে সরকারের নিট ব্যাংকঋণ ছিল মাত্র ১১ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। এরপর মাত্র ১৪ দিনের ব্যবধানে ঋণ বেড়ে যায় ৩৩ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ দশমিক ০৪ লাখ কোটি টাকা। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৪৩ শতাংশ।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সাধারণত অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে সরকারের ঋণ গ্রহণ বাড়ে। তবে তাঁদের মতে, এবার ঋণ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে দুটি বড় কারণ রয়েছে। এর একটি হলো পাঁচটি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়ায় ভর্তুকি হিসেবে অর্থ ছাড়। অন্যটি নির্বাচনকালীন ব্যয়।
তাঁরা আরও জানান, অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে উন্নয়ন ব্যয় প্রায় বন্ধ থাকায় ওই সময়ে সরকারের অর্থের চাহিদা কম ছিল। ফলে তখন ঋণ গ্রহণও সীমিত ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের মোট নিট ঋণের মধ্যে তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে নেওয়া হয়েছে ২৩ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে ২২ হাজার ১১ কোটি টাকা।
এক মাস আগেও, অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নিট ঋণ ছিল ৯ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিট ঋণ ছিল মাত্র ১ হাজার ৯০১ কোটি টাকা।
ডিসেম্বর মাসে অল্প সময়ের নোটিশে ঋণ নিলামের ক্যালেন্ডারেও পরিবর্তন আনা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, নির্ধারিত ক্যালেন্ডারের বাইরে আরও দুটি অতিরিক্ত অকশন নিলাম অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল এবং পাঁচ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের দুটি অতিরিক্ত নিলামের মাধ্যমে বাজার থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ ডিসেম্বর ক্যালেন্ডারের বাইরে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল নিলামের মাধ্যমে সরকার ৫ হাজার কোটি টাকা তোলে। এর আগে, নভেম্বরের শেষ দিকে পাঁচ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড নিলামের মাধ্যমে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। ওই নিলামে সুদহার ছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ক্যালেন্ডারের বাইরে নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা।
তিনি আরও জানান, সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকে ২০ হাজার কোটি টাকার মূলধন সহায়তা দেওয়ায় স্বল্পমেয়াদি তারল্য চাহিদা তৈরি হয়েছে। এই অর্থ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবেই ট্রেজারি বিল ও বন্ড ব্যবহার করা হচ্ছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান বলেন, বর্তমানে সরকারের অধিকাংশ প্রকল্প স্থগিত থাকায় এই উদ্যোগ মূলত অর্থ ব্যবস্থাপনার কৌশল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক কর্মকর্তা জানান, বাড়তি ঋণ গ্রহণ যেন মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ না সৃষ্টি করে, সে জন্য পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে ২৪ নভেম্বরের পর সরকারের মোট ঋণ আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারের এক খাতে অর্থ ছাড় দিয়ে অন্য খাত থেকে ঋণ নেওয়া স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, তবে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার মাত্রা এমন হওয়া উচিত নয়, যাতে বেসরকারি খাতের ঋণগ্রহীতারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বাড়লে সবার জন্য ন্যায্য প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে সতর্ক থাকতে হবে।

