দেশের ব্যাংক খাতে ২০ কোটি টাকার বেশি অঙ্কের সব ঋণ নতুন করে যাচাই করা হবে। এসব ঋণের বিপরীতে যথাযথ জামানত রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। অনিয়ম পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ব্যাংক পরিচালকদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এ কথা বলেন। ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘ব্যাংক খাত সংস্কার: চ্যালেঞ্জ উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা জানান।
গভর্নর বলেন, ব্যাংক খাতে আস্থা পুরোপুরি ফিরে এসেছে, এমন দাবি তিনি করবেন না। তবে আস্থা ধরে রাখার চেষ্টা চলছে এবং আংশিকভাবে সেখানে সফলতা এসেছে। একই সঙ্গে সামগ্রিক অর্থনীতিকে একটি স্থিতিশীল অবস্থানে আনা সম্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে—এমন কোনো আশঙ্কা নেই। ব্যালান্স অব পেমেন্টের অবস্থান শক্তিশালী। ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বড় ধরনের ইতিবাচক অবস্থা রয়েছে। সামগ্রিক ব্যালান্সেও উল্লেখযোগ্য উদ্বৃত্ত আছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, গত বছর রিজার্ভ ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি বেড়েছে। চলতি বছর এরই মধ্যে রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় দেড় থেকে দুই বিলিয়ন ডলার। সামনে তা আরও বাড়বে। তিনি জানান, বাজার থেকে ইতোমধ্যে আড়াই বিলিয়ন ডলারের বেশি কেনা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও কেনা হবে। রিজার্ভ বাড়ানোই বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পষ্ট নীতি।
বিনিময় হার নিয়েও কোনো উদ্বেগ নেই বলে জানান তিনি। ডলারের ওপর চাপ সৃষ্টি না করেই বাজারকে স্থিতিশীল রেখে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
ব্যাংক খাতের গভর্ন্যান্স প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, গভর্ন্যান্স রাতারাতি বদলায় না। অনেক ক্ষেত্রে এটি সাংস্কৃতিক সমস্যা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ১৪টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। অন্য ব্যাংকগুলোতেও অনিয়ম হলে নির্মোহভাবে হস্তক্ষেপ করা হবে।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ব্যাংক লোকসানে থাকলে ডিভিডেন্ড বা বোনাস দেওয়া যাবে না। কৃত্রিম হিসাব দেখিয়ে মুনাফা প্রদর্শনের সুযোগ থাকবে না। ক্ষতির দায় ব্যবস্থাপনা ও মালিকপক্ষ—উভয়কেই নিতে হবে।
গভর্নর জানান, আগামী জানুয়ারি থেকে রিস্ক বেইজড সুপারভিশন পুরোপুরি চালু হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ৫০ জন কর্মকর্তাকে ফরেনসিক অডিট বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
চলতি অর্থবছর শেষে দেশের রিজার্ভ ৩৪ থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। গভর্নর বলেন, আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক থেকে ধার করে রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব নয় এবং তা উচিতও নয়। রিজার্ভ বাড়াতে হবে দেশের অর্থনীতি থেকেই। বাংলাদেশ ব্যাংক ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটে অংশগ্রহণকারী হিসেবে স্বচ্ছভাবে কাজ করবে।
আইএমএফ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইএমএফের অর্থ এলে তা মূলত ভ্যালু বৃদ্ধিতে কারিগরি সহায়তা হিসেবে কাজে আসবে। বাজেটে কিছু দুর্বলতার কারণে সরকার বাজেট সহায়তার জন্য আইএমএফ থেকে অর্থ নিতে পারে। তবে ব্যালান্স অব পেমেন্টের জন্য আইএমএফের অর্থ প্রয়োজন নেই।
ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে গভর্নর বলেন, খাতে তিনটি বড় সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, গভর্ন্যান্সের ঘাটতি পুরোপুরি কাটেনি। দ্বিতীয়ত, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি রয়েছে। সময় দিয়ে এগুলো সমাধান করা হবে। এরপরও যারা পারবে না, তাদের ব্যাংক রেজল্যুশন পরিকল্পনার আওতায় আনা হবে।
তৃতীয় বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। বর্তমানে যা প্রায় ৩৬ শতাংশ। ডিসেম্বরের তথ্য এলে কিছুটা উন্নতি হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। তবে ডাটা কখনো লুকানো হয়নি এবং ভবিষ্যতেও লুকানো হবে না বলে স্পষ্ট করেন গভর্নর।
একীভূতকৃত ব্যাংক প্রসঙ্গে তিনি জানান, পাঁচটি ব্যাংক একীভূতকরণের আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। শিগগিরই ৭৫০টি শাখা যৌক্তিকীকরণ করা হবে। আমানতকারীদের জন্য ডিপোজিট গ্যারান্টি স্কিম অনুযায়ী ২ লাখ টাকা পর্যন্ত তাৎক্ষণিকভাবে প্রদান করা হবে। প্রতিটি আমানতকারীর নামে নতুন ব্যাংকে বিকল্প হিসাব খুলে অর্থ স্থানান্তর করা হবে।
ব্যাংক-বহির্ভূত নয়টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, এনবিএফআইগুলোকে একীভূত করা নয়, বরং লিকুইডেশনের পথে যাওয়া হচ্ছে। এখানে আমানতকারীদের স্বার্থই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। অপব্যবহারকারী স্পন্সর শেয়ারহোল্ডারদের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখানো হবে না। সরকারের প্রতিশ্রুত অর্থের ভিত্তিতে আমানতকারীদের মূল টাকা ফেরত দেওয়া হবে।
ইআরএফ সভাপতি দৌলত আক্তার মালার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।

