উচ্চ সুদ ও বিনিয়োগের ঝুঁকি কমাতে মানুষ ব্যাংকে নগদ টাকা জমা দিচ্ছে। ছোট ও মাঝারি বিনিয়োগকারীরাও লোকসানের আশঙ্কায় পুঁজিবাজারে অংশ নিচ্ছেন না। এ অবস্থায় ব্যাংকের আমানতই নিরাপদ ও লাভজনক মনে হচ্ছে। এই প্রবণতা প্রকাশ পেয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, মানুষ নগদ টাকা হাতে না রেখে ব্যাংকে জমা রাখার দিকে ঝুঁকছে। এতে বিনিয়োগ স্থবির হওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকে অলস টাকার পরিমাণও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের বাইরে থাকা নগদ অর্থ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
২০২৫ সালের জুনে ব্যাংকের বাইরে মুদ্রার পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৯৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। তিন মাস পর, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৭৪ হাজার ৭২৪ কোটি টাকায়। অর্থাৎ তিন মাসে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ কমেছে ৭.৩২ শতাংশ। মানে ২১ হাজার ৭২৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা নগদ আবার ব্যাংকে ফিরেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতি কড়াকড়ি হওয়ায় মানুষের ভোগ ও বিনিয়োগ প্রবণতা কমছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় আস্থা কমার কারণে নগদ টাকা ব্যাংকে ফেরছে। একই সঙ্গে ঋণের ওপর সুদের হার বৃদ্ধির ফলে মানুষ ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারছে না। এর ফলে তাদের খরচও বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকিং খাতে আস্থা পুনরুদ্ধার, আমানতের ওপর তুলনামূলক আকর্ষণীয় সুদ এবং আর্থিক লেনদেনে নজরদারি বৃদ্ধির কারণে মানুষ নগদ ঘরে না রেখে ব্যাংকে রাখছে। ডিজিটাল লেনদেন ও মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসের ব্যবহার বাড়াও ব্যাংকের বাইরে মুদ্রা কমানোর পেছনে ভূমিকা রাখছে। ব্যাংকের বাইরে নগদ কমা সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। এতে ব্যাংকের তারল্য ও ঋণ বিতরণের ক্ষমতা বেড়ে বিনিয়োগ ও উৎপাদন খাতেও গতি আসতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সরকার পরিবর্তন ও কয়েকটি ব্যাংকের পুনর্গঠনের কারণে মানুষ আগে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রেখেছিল। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে ব্যাংকের ওপর আস্থা ফেরত এসেছে। অতিরিক্ত টাকা হাত থেকে ব্যাংকে ফিরছে। সুদের হার বাড়ায় নতুন আমানতও আসছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের কারণে সঞ্চয়ের ক্ষমতা সীমিত। তাই আমানত প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ছে না। আমানত না বাড়লে বিনিয়োগও বাড়বে না, আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান ও আয় বাড়বে না। সেক্ষেত্রে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি হতে পারে। বিনিয়োগ বাড়াতে স্থিতিশীল পরিবেশ জরুরি।’
এদিকে ব্যাংকিং খাতে আমানত বৃদ্ধিও দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুনে দেশের ব্যাংকের মোট আমানত ছিল ১৮ লাখ ৭৮ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। তিন মাসে তা বেড়ে ১৯ লাখ ১৫ হাজার ২৫৩.৫০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। অর্থাৎ তিন মাসে আমানত বেড়েছে ৩৭ হাজার ৮৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের পর কয়েকটি ব্যাংকের পর্ষদ ভাঙার কারণে ব্যাংকে আস্থা কমেছিল। মানুষ হঠাৎ টাকা তুলে নিয়েছিল। সেই সময় বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য সহায়তা দিয়েছিল। তবে এক বছরের মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টেছে। কিছু ব্যাংকের ওপর আস্থা কমলেও পুরো খাতের ওপর আস্থা কমেনি। ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ আবার ব্যাংকে ফিরছে। আমানত এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে স্থানান্তর হয়েছে। এটি ব্যাংক খাতের জন্য ভালো খবর। আমরা ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরানোর জন্য কাজ করছি। মুদ্রাপাচার বন্ধ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করি শিগগিরই সাধারণ আমানতকারীর আস্থা আরও বাড়বে।’

