দেশের পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানতে প্রবৃদ্ধি ধীর হলেও প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। গত অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ইসলামী ব্যাংকিং আমানত ৪১ শতাংশ বেড়ে প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। একই সময়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত বেড়েছে ৪ শতাংশেরও কম।
শুধু আমানত নয়। শরিয়াহভিত্তিক ঋণ বা বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত অক্টোবরভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকিং সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। এদিকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক পরিচালিত এক্সিম ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে। এসব ব্যাংক মিলিয়ে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক গঠন করা হচ্ছে।
এই একীভূতকরণের ফলে দেশে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের সংখ্যা ১০টি থেকে কমে ছয়টিতে নামবে। একই সঙ্গে দেশের মোট ব্যাংকের সংখ্যা কমে দাঁড়াবে ৫৭টিতে। ৩৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করবে। এই পাঁচ ব্যাংকের প্রায় ৭৬ লাখ আমানতকারীকে আমানত বীমা ট্রাস্ট তহবিল থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত দেওয়া হবে। এ জন্য তহবিল থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এই তহবিল গড়ে উঠেছে ব্যাংকগুলোর চাঁদার মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানান, পাঁচ ব্যাংকের আমানতকারীদের হিসাব নবগঠিত সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। চলতি সপ্তাহের মধ্যে কাজ শেষ হলে বিদ্যমান পাঁচ ব্যাংকের সব আমানত স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন ব্যাংকের হিসাবে চলে যাবে।
তিনি বলেন, এরপর আমানতকারীরা তাদের বর্তমান চেক বই ব্যবহার করে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত উত্তোলন করতে পারবেন। অবশিষ্ট আমানত সংশ্লিষ্ট হিসাবে সুরক্ষিত থাকবে। ওই আমানতের ওপর প্রচলিত হারে মুনাফাও দেওয়া হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হওয়ায় নতুন ব্যাংকটি জনআস্থা ফিরিয়ে আনবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এতে করে হঠাৎ করে টাকা তোলার চাপও কমে আসবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংক।
বর্তমানে দেশে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট শাখা রয়েছে এক হাজার ৬৯৯টি। এর মধ্যে একীভূত হয়ে গঠিত সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকের শাখা সংখ্যা ৭৬১টি। একীভূত হলেও আপাতত কোনো শাখা বন্ধ করা হবে না। তবে একই এলাকায় একাধিক শাখা থাকলে প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু শাখা অন্যত্র স্থানান্তর করা হবে। পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের বাইরে প্রচলিত ধারার ১৭টি ব্যাংকের ৪১টি ইসলামী ব্যাংকিং শাখা রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে ৩৩৪টি ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো। এ ছাড়া প্রচলিত ধারার আরও ১২টি ব্যাংকের অধীনে রয়েছে ৫৮৫টি ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ইসলামী ব্যাংকিং আমানত ৪১ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকায়। এক বছর আগে এই অঙ্ক ছিল ৪৬ হাজার ৬২২ কোটি টাকা।
অন্যদিকে একই সময়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত বেড়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। তাদের মোট আমানত দাঁড়িয়েছে চার লাখ এক হাজার ৪৭৩ কোটি টাকায়। সব মিলিয়ে গত অক্টোবরে ইসলামী ব্যাংকিং খাতে মোট আমানত ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়ে চার লাখ ৬৭ হাজার ৪২৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
তবে সার্বিক ব্যাংক খাতের তুলনায় ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অংশ কমেছে। গত অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে ব্যাংক খাতের মোট আমানত ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৭১ হাজার ৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অংশ নেমে এসেছে ২২ দশমিক ৫৭ শতাংশে। আগের বছর অক্টোবর শেষে মোট আমানতের ২৩ দশমিক ১০ শতাংশ ছিল ইসলামী ব্যাংকিংয়ের দখলে।
ঋণ বা বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। গত অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ ১১ দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়ে পাঁচ লাখ ৭৬ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ইসলামী ব্যাংকিং ঋণ ৩৫ দশমিক ২৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫১ হাজার ৩১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, খারাপ অবস্থায় পড়া কয়েকটি ব্যাংকের বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ায় আদায় কার্যত বন্ধ রয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে এসব ব্যাংকের ঋণ তেমন কমছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আরও জানান, কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার মারাত্মক অবনতির কারণে ২০২২ সাল থেকে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। তবে সাম্প্রতিক কয়েক মাসে আস্থা কিছুটা ফিরেছে। সে কারণে মোট আমানত সামান্য হলেও বেড়েছে। যদিও ব্যাংক খাতের মোট আমানতে তাদের অংশ কমেছে।
একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকগুলো থেকে দীর্ঘদিন ধরে আমানতকারীরা টাকা তুলতে পারছিলেন না। ফলে আগের মতো করে আমানত কমেনি। ২০২২ সালে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকে জালিয়াতির তথ্য প্রকাশের পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন অনেক আমানতকারী টাকা তুলে নিতে শুরু করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুনে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত ছিল চার লাখ এক হাজার ৩০২ কোটি টাকা। সে সময় ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১৬ লাখ ২৪ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। মোট আমানতে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অংশ ছিল ২৪ দশমিক ৭০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড দখলের আগ পর্যন্ত বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণ বজায় রেখেও ইসলামী ব্যাংকগুলোর হাতে বিপুল উদ্বৃত্ত অর্থ থাকত। অনেক সময় মোট উদ্বৃত্ত তহবিলের প্রায় ৮০ শতাংশই এসব ব্যাংকের হাতে থাকত।
তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলো প্রচলিত ধারার বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করতে না পারায় এই উদ্বৃত্ত তৈরি হতো। সে কারণে সরকার সুকুকসহ শরিয়াহভিত্তিক বন্ডের প্রচলন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। তবে ২০২২ সালে জালিয়াতির তথ্য সামনে আসার পর আমানত ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ঋণের বড় অংশ বেনামি হওয়ায় তা আদায়ও হচ্ছে না। এর ফলে অনেক ব্যাংক এখন আমানতকারীদের জমানো টাকা ফেরত দিতে পারছে না।

