ব্যাংক এশিয়া এবার স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল কৌশলে তার খারাপ ঋণ কমাতে উদ্যোগ নিয়েছে। ঋণ পুনঃনির্ধারণের ক্ষেত্রে আকস্মিক সমাধান দেওয়ার বদলে ব্যাংক চায় ঋণগ্রহীতাদের অংশীদারিত্ব বিনিয়োগ, অতিরিক্ত জামানত এবং সঠিক পরিশোধ পরিকল্পনা অনুসরণ করতে।
ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহেল আরকে হোসেন জানান, “আমরা ধারাবাহিক ও নিয়মিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আগামী বছরের মধ্যে খারাপ ঋণকে একক অঙ্কে নামানোর লক্ষ্য রেখেছি।” তিনি আরও বলেন, “কঠোর ঋণ শ্রেণীবিন্যাস নীতির কারণে প্রোভিশন বাড়াতে হবে। এটি অল্প সময়ের জন্য ব্যাংকের মুনাফা এবং মূলধন পর্যাপ্ততায় প্রভাব ফেলতে পারে।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, “আগামী ৩–৫ বছরের মধ্যে ব্যাংক এশিয়া দেশের শীর্ষ দুই বা তিনটি ব্যাংকের মধ্যে থাকতে চায়, শুধু সম্পদ বা মুনাফায় নয়, বরং কার্যকারিতা, সম্পদের গুণমান, মূলধন শক্তি, শাসনব্যবস্থা, স্বচ্ছতা ও টেকসইতায়।”
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও মুনাফা বৃদ্ধির ইঙ্গিত:
চলতি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ব্যাংক এশিয়া ২০২৫ সালের প্রথম ৯ মাসে শক্তিশালী ফলাফল দেখিয়েছে। ট্যাক্সের পর মুনাফা ৩৫১ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা গত বছরের তুলনায় ৭১% বৃদ্ধি, আর শেয়ার প্রতি আয় বেড়েছে ৭৯% হয়ে ২.৫৮ টাকায়। নেট অ্যাসেট ভ্যালু ২১% বেড়ে ২৯.২৮ টাকায় উন্নীত হয়েছে।
ব্যাংকের তরল সম্পদও শক্তিশালী রয়েছে—লিকুইডিটি কভারেজ রেশিও ৩৫৬% এবং নেট স্টেবল ফান্ড রেশিও ১০৬%, আর মূলধন পর্যাপ্ততা ১৪.৮২%। খরচ-থেকে-আয় অনুপাত ৩৬.৮% যা শিল্পের মধ্যে অন্যতম ন্যূনতম, যা কার্যকারিতার প্রমাণ দেয়। ব্যাংক এশিয়া অতিরিক্ত তরল সম্পদ সরকারি সিকিউরিটিতে বিনিয়োগ করেছে, ফলস্বরূপ বিনিয়োগ থেকে আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আমানত বেড়েছে ১২% পৌঁছে ৪৪৬,১৫৩ মিলিয়ন টাকায়। ঋণের শৃঙ্খলিত ব্যর্থতা কিছুটা বেড়েছে, তবে যথাযথ প্রোভিশন থাকায় ব্যাংক সুরক্ষিত। প্রোভিশন কভারেজ ৮৬.৩৯% এ উন্নীত হয়েছে, যা সম্ভাব্য ক্ষতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী সুরক্ষা তৈরি করে।
ঋণ পুনরুদ্ধারে কৌশল: আকস্মিক পুনঃনির্ধারণ নয়:
ব্যাংক এশিয়া ঋণ পুনঃনির্ধারণে হঠাৎ কোনো ছাড় দেয়নি। বরং তারা ঋণগ্রহীতাদের উৎসাহ দিচ্ছে—নিজস্ব অর্থ যোগ করা, অতিরিক্ত জামানত রাখা এবং ঠিকমতো পরিশোধের পরিকল্পনা মানা। প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এই সঠিক পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে আগামী বছরের মধ্যে ব্যর্থ ঋণ কমানো এবং ঋণের হিসাব আরও পরিষ্কার রাখা সম্ভব হবে।”
গ্রাহকসেবা ও পণ্য বৈচিত্র্যে এগিয়ে ব্যাংক এশিয়া:
ব্যাংক এশিয়ার মূল লক্ষ্য সব ধরনের গ্রাহককে অন্তর্ভুক্ত করা এবং নতুনত্ব আনা। শহর-গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত, পরিবারিক, কর্পোরেট ও উদ্যোক্তা গ্রাহকদের জন্য বৈচিত্র্যময় পণ্য দেওয়া হচ্ছে।
আমরা বিভিন্ন ধরনের আমানত পণ্য দিই—রেগুলার ও স্টার সেভিংস একাউন্ট, ডাবল ও ট্রিপল বেনিফিট স্কিম, মাসিক বেনিফিট স্কিম এবং বয়স্কদের জন্য নির্ভাবনা একাউন্ট। স্টার সেভিংস একাউন্টে জীবন বীমা এবং বাইরে থেকে চিকিৎসার সুবিধা রয়েছে, যা প্রবাসী প্রেরিত অর্থের গ্রাহকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দীর্ঘমেয়াদী সঞ্চয়কারীদের জন্য ডিপিএস প্লাস এবং আছল একাউন্ট, আর নির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুসারে সঞ্চয় করতে শঞ্চয়-ই-কোটিপতি ও ভ্রমণ পরিকল্পনা। ইসলামী মোদারাবা একাউন্ট, শিক্ষার্থী ও পেরোল একাউন্টও প্রদান করা হচ্ছে।
ডিজিটাল ক্ষেত্রে ব্যাংকিং আরও সহজ ও স্মার্ট করা হয়েছে। ব্যাংক এশিয়ার ‘স্মার্টঅ্যাপ’-এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ ডিজিটালভাবে নতুন হিসাব খোলা সম্ভব। ‘ঘরে বসে হিসাব খোলুন’ ফিচারের মাধ্যমে যেকোনো সময়ে দূর থেকে একাউন্ট খোলার সুবিধা পাওয়া যায়। এছাড়া ছোট ও মাঝারি ব্যবসার জন্য ঋণ আবেদন এবং অনলাইন অনুমোদনের সুবিধা চালু করা হয়েছে।
ঋণের নতুন ধারা অনুযায়ী শ্রেণীবিন্যাস ও ক্ষতি মোকাবিলার প্রস্তুতির চ্যালেঞ্জ:
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে ঋণ শ্রেণীবিন্যাস ও ক্ষতি মোকাবিলার জন্য নতুন নির্দেশিকা জারি করেছে। আগামী দুই বছরে ব্যাংকগুলোকে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিবেদনকরণের মান ৯ (International Financial Reporting Standard 9)-এর ‘প্রত্যাশিত ঋণ ক্ষতি’ মডেল অনুসরণ করতে হবে। এটি ঋণ ঝুঁকি নিরূপণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন।
নতুন নিয়ম অনুসারে কিছু ঋণ অতি শীঘ্রই ব্যর্থ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হবে। ফলে সম্ভাব্য ক্ষতির জন্য রাখা অর্থ বাড়াতে হবে, যা অল্প সময়ের জন্য ব্যাংকের মুনাফা এবং মূলধনের পর্যাপ্ততায় প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সঠিক প্রস্তুতি ও দক্ষতা থাকলে এই পরিবর্তন ব্যাংকিং খাতকে আরও শক্তিশালী করবে।
মোট ঋণের ৩৪% বা ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি নন-পেরফর্মিং লোন থাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ব্যাংকিং খাত চাপের মুখে। ব্যাংক এশিয়ার কৌশল হলো—ঋণ পুনরুদ্ধার, নতুন ঋণ অনুমোদনে সতর্কতা এবং ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ। বড় কর্পোরেট ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার আগে ঝুঁকি যাচাই করা হচ্ছে।
বিগত বছরের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৩.৯৭%, যা তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। ব্যক্তিগত খাতের ঋণ বৃদ্ধিও ৬.৪% এ নেমেছে। ফলে ব্যাংকিং খাতের ঋণ বৃদ্ধি ধীর। অতিরিক্ত তরল সম্পদ তৈরি হচ্ছে, সিস্টেমে চাপ বাড়ছে এবং মুনাফায় প্রভাব পড়ছে। ফিরেও, খাতটি নতুনত্ব, ডিজিটাল রূপান্তর ও নতুন বিনিয়োগ পথ খোঁজার মাধ্যমে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও তৎকালীন সরকার ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ঋণ মামলা আদালত আইন, দেউলিয়া আইন, এবং ২০২৫ সালের সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক পরিচালনার আইন পরিবর্তন প্রস্তাব করা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো পরিচালনায় স্বচ্ছতা, শৃঙ্খলা ও দ্রুত ঋণ পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করবে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—মধ্যস্থ ব্যাংকের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। পূর্ববর্তী ১০–১৫ বছরে শাসন ব্যর্থতার কারণে খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ব্যাংক এশিয়ার লক্ষ্য—আগামী ৩–৫ বছরে দেশের শীর্ষ দুই-তিন ব্যাংকের মধ্যে থাকা। শুধু সম্পদ ও মুনাফা নয়, কার্যকারিতা, সম্পদের গুণমান, মূলধন শক্তি, শাসন, স্বচ্ছতা ও টেকসইতায়ও শীর্ষে থাকা।
ব্যক্তিগত ও ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসার খাতকে সম্প্রসারণের মাধ্যমে মোট ঋণের অন্তত ৫০% অঙ্গীকার করা হবে। নতুন শাখা, এজেন্ট নেটওয়ার্ক ও বিদেশি অফিসের মাধ্যমে ব্যাংকের উপস্থিতি বাড়ানো হবে। সংক্ষেপে, ব্যাংক এশিয়া হতে চায়—প্রযুক্তিনির্ভর, গ্রাহক-কেন্দ্রিক, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান।

