দেশের অর্থনীতির মূলভিত্তি ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত। সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য রফতানি হচ্ছে বিশ্বের নানা দেশে। অথচ এই খাতের উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। ব্যাংকগুলোও ঋণ দিতে তেমন আগ্রহ দেখায় না।
বড় শিল্প গ্রুপ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয় অথবা কেউ বিদেশে পাচার করে। তবে এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ খেলাপি কম। অধিকাংশ সময় তারা ঋণ সময়মতো পরিশোধ করে। তবুও ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয়। অনেক ব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নেয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার সময়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর কটেজ, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের ঋণ বিতরণ কমে গেছে। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতের মোট ঋণের মাত্র ১৭ শতাংশ ছিল সিএমএসএমই খাতের। এটি গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের একটি সভায় এই খাতে ঋণ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে।
ঋণ কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি সিএমএসএমই খাতে ঋণ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ঋণ বিতরণ সহজ করতে নতুন ছাড়ও দিয়েছে। ব্যাংকগুলোকে সিএমএসএমই ঋণের বিপরীতে কম নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশনিং) রাখতে হবে। ফলে ব্যাংকগুলো এই খাতে ঋণ দিতে আগ্রহী হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে স্ট্যান্ডার্ড ও স্পেশাল মেনশন (এসএমএ) বকেয়া ঋণের বিপরীতে যথাক্রমে ১ ও ৫ শতাংশ হার সংরক্ষণ করতে হয়। ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব অশ্রেণিকৃত স্বল্পমেয়াদি কৃষিঋণ ও সিএমএসএমই উদ্যোগের ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো ১ শতাংশের পরিবর্তে ০.৫০ শতাংশ হার প্রযোজ্য করতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য, চলতি বছরের মধ্যে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের অন্তত ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে বিতরণ নিশ্চিত করা। ২০২৯ সালের মধ্যে তা বাড়িয়ে ২৭ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ ছিল ১৮ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সিএমএসএমই খাতের ঋণ ছিল ৩ লাখ ১১ হাজার কোটি, যা মোট ঋণের ১৭ দশমিক ০৬ শতাংশ। ২০২৪ সালে এই হার ছিল ১৮ দশমিক ৪০ এবং ২০২৩ সালে ১৯ দশমিক ১১ শতাংশ। সিএমএসএমই খাতে ঋণ ধীরে ধীরে কমছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। তারপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ বাড়াতে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের খুঁজছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী বছরে সব ধরনের ঋণে ভালো প্রবৃদ্ধি দেখা যাবে।
সিএমএসএমই ঋণের অন্তত ৪০ শতাংশ বিতরণ উৎপাদন উপখাতে নিশ্চিত করতে হবে। জুন পর্যন্ত উৎপাদন উপখাতে বিতরণ হয়েছে ৩৬ শতাংশ, সেবা উপখাতে ১৯ শতাংশ এবং ব্যবসা-ট্রেড উপখাতে ৪৪.৭৬ শতাংশ।
ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বোচ্চ ঋণসীমা বাড়িয়েছে। কুটির উদ্যোগে ২০ লাখ, মাইক্রো উদ্যোগে ২ কোটি, ক্ষুদ্র উদ্যোগে ২৫ কোটি এবং মাঝারি উদ্যোগে ১০০ কোটি টাকা ঋণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
আগে থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নারীর উদ্যোক্তাদের বিনা জামানতে ২৫ লাখ টাকা ও অন্য উদ্যোক্তাদের ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। টিআইএন নেই এমন উদ্যোক্তাও অন্যান্য ব্যবসাসংক্রান্ত সনদ দেখিয়ে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারেন। তবুও ব্যাংকগুলো করপোরেট ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী। কারণ, করপোরেট ঋণে ব্যাংকের জন্য লাভ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের সিএমএসএমই ঋণের অংশ জুন শেষে কমে ১৭.৪৭ শতাংশে নেমেছে। ২০২৪ সালে এটি ছিল ১৭.৯৬ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকের ঋণ ৯.২৫ থেকে ৬.২৮ শতাংশে নেমেছে। বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ ১৯.১২ থেকে ১৭.৬৮ শতাংশে কমেছে। ইসলামী ব্যাংকের ঋণ ১৮.১৪ থেকে ১৬.১১ শতাংশে নেমেছে। তবে সিএমএসএমই খাতে বিশেষায়িত ব্যাংকের ঋণ বেড়ে ১৭.৬৯ থেকে ২১.৫৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

