দেশে ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন রেজিস্ট্রার—সংক্ষেপে এনইআইআর—চালু হতে এখন আর মাত্র ১২ দিন বাকি। ঠিক এই সময়ে এসে হ্যান্ডসেট বাজারের সবচেয়ে বড় অংশীদার ‘গ্রে মার্কেট’ ব্যবসায়ীরা পড়েছেন গভীর উদ্বেগে। কারণ, এখনো পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে তাদের কোনো সমঝোতা হয়নি।
সরকার বলছে, বৈধভাবে মোবাইল আনতে শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে—কিন্তু কতটা কমানো হবে, সেটা এখনো চূড়ান্ত নয়। আর ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তাদের সঙ্গে আলোচনাই করা হচ্ছে না। অথচ বাজারে কয়েকশ কোটি টাকার অবিক্রিত ফোন পড়ে আছে, যার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
১৬ ডিসেম্বরের পর কী হবে?
দেশে ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে এনইআইআর, যেখানে নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকতে হলে প্রতিটি হ্যান্ডসেটের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। সরকার নিশ্চিত করেছে—১৬ ডিসেম্বরের আগে যেসব ফোন চালু ছিল, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে না।
কিন্তু ঝুঁকিতে পড়ছে সেই বিশাল ব্যবসা, যা এতদিন শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দেশে হ্যান্ডসেট এনে ‘গ্রে মার্কেট’ নামে পরিচিত ছিল। সরকারি হিসেব বলছে—দেশের হ্যান্ডসেট বাজারে গ্রে মার্কেটের দখল ৬০ শতাংশেরও বেশি। আর ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, বাস্তবে তা ৯০ শতাংশ।
গত এক যুগে ঢাকার বড় বড় বিপণী বিতানে এই ব্যবসার শো-রুমগুলোই হয়ে উঠেছে মোবাইল বাজারের প্রাণকেন্দ্র।

সরকার–ব্যবসায়ী দূরত্ব কেন বাড়ছে?
ব্যবসায়ীরা বারবার বলছেন—তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। কৌশলে ‘গুটিকয়েক ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে’ পুরো গ্রে মার্কেটকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে বলে তারা অভিযোগ করছেন। তারা আশঙ্কা করছেন—এই সিদ্ধান্তে বাজারে মোবাইলের দাম বাড়বে এবং বৈধ আমদানিকারকদের একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি হবে।
বিটিআরসি এবার দেশীয় মোবাইল উৎপাদনকারী ১৭টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে এনইআইআর বাস্তবায়নে নেমেছে। সরকারের ভাষ্য—গ্রে মার্কেটের ব্যবসায়ীদের বৈধ পথে আনার সুযোগ দেওয়া হবে, এবং বাজারে থাকা ফোনগুলোকে প্রক্রিয়ায় এনে বৈধ করা হবে।
কিন্তু ব্যবসায়ী মহলের অবিশ্বাস কাটছে না। তারা ইতোমধ্যে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি চালাচ্ছেন। এর মধ্যে তাদের সংগঠনের শীর্ষজনদের ডিবি পরিচয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও উঠেছে, যদিও পরে তারা ফিরে এসেছেন।
শুল্ক কমানো নিয়ে সরকারের নতুন বার্তা
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে—১ ডিসেম্বর এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং বিটিআরসির বৈঠকে বৈধ পথে স্মার্টফোন আমদানির শুল্ক “উল্লেখযোগ্য হারে” কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বর্তমানে বৈধ পথে ফোন আনতে শুল্ক দিতে হয় প্রায় ৬১ শতাংশ। শুল্ক কমানো হলে দেশীয় কারখানাগুলোতেও কর-ভ্যাট কমাতে হবে, নইলে বিদেশি বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে—সেকথাও বলা হয়েছে।
অবিক্রিত ফোন বৈধতার ব্যাপারটি কোথায় দাঁড়িয়ে?
মন্ত্রণালয় বলেছে—শুধুমাত্র আইএমইআই নম্বরযুক্ত স্টক ফোনগুলো তালিকা দিয়ে কম শুল্কে বৈধ করা হবে। তবে ক্লোন ফোন বা রিফারবিশড ফোন এই সুবিধার আওতায় আসবে না।
কিন্তু এখানেই আসছে বড় বিতর্ক। গ্রে মার্কেটের বড় অংশের ফোন এক আইএমইআই নম্বরে বহু ফোন হিসেবে প্রবেশ করেছে—যা ‘ক্লোন ফোন’ হিসেবে চিহ্নিত। বিটিআরসি বলছে, একেকটি আইএমইআই নম্বরের বিপরীতে কয়েক লাখ ফোনও বাজারে এসেছে—এগুলোকেই তারা বাদ দিতে চায়।
ব্যবসায়ীদের দাবি—এ ধরনের ফোন ইতোমধ্যেই বিপুল পরিমাণে বাজারে রয়েছে। হঠাৎ এগুলোকে বাতিল করে দিলে লাখো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পথে বসবে।
গ্রে মার্কেট ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ
মোবাইল বিজনেস কমিউনিটির সভাপতি মো. আসলাম বলেন,
“আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। কোনো রোডম্যাপ নেই। অথচ হাতে মাত্র ১২ দিন। এই বাজারে ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষ কাজ করে—তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে?”
তার কথায়, এতদিন যেসব ফোন তারা বিক্রি করেছেন, সেগুলো হঠাৎ ‘অবৈধ’ ঘোষণা করা হচ্ছে। অথচ তারা চাইলেই বৈধ পথে ব্যবসা করতে পারতেন, যদি স্পষ্ট নীতি থাকত।
এখন সমস্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে পুরো গ্রে মার্কেট দাঁড়িয়ে আছে—কোন সিদ্ধান্তে কাকে কী সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তা জানার সুযোগও পাচ্ছেন না তারা।

