বাংলাদেশ ২০২৩ সালের জুনে হংকং আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুমোদন করেছে। এই কনভেনশনটি কার্যকর হবে ২০২৫ সালের জুনে। তাই এখন থেকেই এর বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নেওয়া খুব জরুরি।
বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙা শিল্প শুরু হয় ১৯৮০ সালের দিকে। তখন থেকে এই খাত দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে। এই শিল্প লোহা গলানোর কারখানাগুলোতে কাঁচামাল সরবরাহ করে। একই সঙ্গে এটি বহু মানুষের কর্মসংস্থানও তৈরি করে।
তথ্য অনুযায়ী, এই শিল্প দেশের লোহা খাতের ৬০ শতাংশ কাঁচামাল সরবরাহ করে। এতে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা চলে। কেউ স্থায়ীভাবে কাজ করেন। কেউ আবার অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করেন। কিন্তু কনভেনশন চালু হলে পরিস্থিতি বদলে যাবে।
এই নিয়ম চালু হলে শুধু অনুমোদিত পরিবেশবান্ধব ইয়ার্ডে জাহাজ ভাঙা যাবে। অন্য কোথাও তা সম্ভব হবে না। বর্তমানে দেশে ৫ থেকে ৭টি গ্রিন ইয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে আছে PHP, SN কর্পোরেশন এবং KR শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ড। এসব ইয়ার্ড আন্তর্জাতিক সনদ পেয়েছে।
এছাড়া আরও ১৫টি ইয়ার্ড এই মান পূরণের চেষ্টা করছে। তারা এই কাজের পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় করছে। কিন্তু বেশিরভাগ ইয়ার্ড এখনো নিয়ম মানতে পারেনি। ফলে ভবিষ্যতে তারা জাহাজ ভাঙার সুযোগ পাবে না।
এই পরিস্থিতিতে অনেক মানুষ কাজ হারাবে। রি-রোলিং মিলগুলো কাঁচামালের অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে চাকরির সুযোগ কমে যাবে। দেশে লোহার জোগান ঠিক রাখতে সরকারকে তখন বিদেশ থেকে কাঁচামাল আনতে হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ পড়বে। দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এই সুযোগে ভারত ও পাকিস্তান লাভবান হতে পারে। ভারতের গুজরাটে অনেক গ্রিন ইয়ার্ড আছে। সরকার তাদের সহায়তা দিচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক দেশের দৃষ্টি ভারতের দিকে যাচ্ছে। তারা সেখানে জাহাজ ভাঙার কাজ করাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
তবে বাংলাদেশের আরেকটি বড় সমস্যা হলো, এখনো টিএসডিএফ (বিপজ্জনক বর্জ্য সংরক্ষণের কেন্দ্র) তৈরি হয়নি। এটি হংকং কনভেনশনের একটি শর্ত। অথচ এখনো কেবল জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। আগামী এক বছরের মধ্যে এটি চালু হওয়ার সম্ভাবনা কম।
ফলে এখনো পরিবেশ দূষণ চলছে। কিছু গ্রিন ইয়ার্ড নিজের খরচে বর্জ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো টিএসডিএফ না থাকায় সমস্যা থেকে যাচ্ছে। এটি পরিবেশের জন্য বিপদজনক। দ্রুত এই কেন্দ্র স্থাপন করা দরকার। এটি শুধু কনভেনশনের শর্ত নয়। এটি দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির স্বার্থেও জরুরি।
আইনি কাঠামোতেও সমস্যা আছে। ২০১১ সালে সরকার জাহাজ নির্মাণ ও পুনর্ব্যবহার বিধি তৈরি করে। এটি করা হয় হাইকোর্টের নির্দেশে। তখন সংসদে কোনো আইন ছিল না যা সরকারকে এই বিধি তৈরির ক্ষমতা দিত।
২০১৮ সালে সরকার ‘বাংলাদেশ শিপ রিসাইক্লিং আইন’ পাস করে। এই আইনে একটি বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়। বোর্ডের হাতে সব নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু এখনো বোর্ড গঠিত হয়নি। প্রশাসনিক জটিলতার কারণে এই কাজ আটকে আছে।
এই আইনের ধারা ৩৭ অনুযায়ী, বোর্ডের অনুমতি ছাড়া কোনো আদালত মামলাও নিতে পারবে না। ফলে আদালত ও প্রশাসন—দু’টিই বোর্ডের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কিন্তু বোর্ড গঠিত না হওয়ায় কার্যক্রম থেমে আছে।
কনভেনশন নিয়ে আরেকটি বড় প্রশ্ন হলো—এর সব দায় জাহাজ ভাঙা দেশের ওপর চাপানো হয়েছে। অথচ জাহাজ মালিক বা দালালদের তেমন কোনো দায়িত্ব নেই। এতে বৈষম্য তৈরি হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। কর্মসংস্থান বজায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক নিয়ম মানতে হবে। এজন্য প্রশাসনিক, অবকাঠামো ও পরিবেশগত বাধা দূর করতে হবে। কনভেনশনের সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতেই হবে।

