নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খুলে কর্মচারীকে মালিক সাজিয়ে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ৪৮ কোটি টাকার ভুয়া ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, তার স্ত্রী ও ইউসিবির দুই সাবেক এমডিসহ ৪৭ জনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আজ বৃহস্পতিবার, ৭ আগস্ট দুদকের ঢাকা ও চট্টগ্রামের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা দুটি দায়ের করেন সহকারী পরিচালক শোয়াইব ইবনে আলম এবং উপ-সহকারী পরিচালক মো. সজীব আহমেদ। দুদকের একটি উচ্চপর্যায়ের সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
চট্টগ্রামের জুবলী রোড শাখায় ‘ক্রিসেন্ট ট্রেডার্স’ নামের একটি নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। এরপর প্রতিষ্ঠানটির কথিত মালিক সৈয়দ নুরুল ইসলাম ঋণের জন্য আবেদন করেন। সেই আবেদনের ভিত্তিতে শাখার কর্মকর্তারা ভুয়া পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করেন এবং শাখার ক্রেডিট কমিটির সদস্যরা যাচাই ছাড়াই ২৫ কোটি টাকার ঋণ সুপারিশ করেন।
প্রস্তাবটি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হলে সেখানকার ক্রেডিট কমিটি ১৭টি নেতিবাচক পর্যবেক্ষণ থাকা সত্ত্বেও ৪৫৭তম পরিচালনা পর্ষদ সভায় ঋণ অনুমোদন দেয়। সংশ্লিষ্টরা মিথ্যা কাগজপত্র দাখিল করে, কর্মচারীর আত্মীয়কে মালিক সাজিয়ে এই ভুয়া ঋণ অনুমোদন করান এবং পরে অর্থ উত্তোলন ও স্থানান্তরের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং করেন। এ ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪০৯, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১, ১০৯ ধারাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২)(৩) ধারায় মামলা করা হয়েছে।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী, তার স্ত্রী ও ইউসিবির সাবেক চেয়ারম্যান রুকমীলা জামান, সাবেক চেয়ারম্যান এম এ সবুর, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শওকত জামিল, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বজল আহমেদ বাবুল, সাবেক পরিচালক ইউনুছ আহমদ, হাজি আবু কালাম, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, রোকসানা জামান চৌধুরী, বশির আহমেদ, সৈয়দ কামরুজ্জামান, মো. শাহ আলম, ড. মো. জোনাইদ শফিক, সাবেক পরিচালক তৌহিদ সিপার রফিকজ্জামানসহ আরও অনেকে।
তালিকায় আরও রয়েছেন ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও গ্রাহকরা, যেমন—সাবেক এফএভিপি মো. মজিবুর রহমান, ম্যানেজার মোহাম্মদ লোকমান আহম্মেদ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার সাইফুল ইসলাম, কান্তা দাশ গুপ্তা, শাখা প্রধান আবদুল করিম, এবং প্রতিষ্ঠানের কথিত মালিক সৈয়দ নুরুল ইসলামসহ মোট ২৩ জন।
একই কৌশলে ‘প্রগ্রেসিভ ট্রেডিং’ নামের আরও একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ইউসিবির কারওয়ান বাজার শাখা থেকে ২৩ কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ হোছাইন চৌধুরী ছিলেন আরামিট সিমেন্ট লিমিটেডের সহকারী হিসাব ব্যবস্থাপক। শাখা কর্মকর্তারা ভুয়া পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করে ঋণের সুপারিশ করেন। এরপর ৪২৪তম পরিচালনা পর্ষদ সভায় তা অনুমোদিত হয়। এখানেও একই ধরনের প্রতারণা, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছে।
সাইফুজ্জামান চৌধুরী, তার স্ত্রী রুকমীলা জামান, ইউসিবির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বজল আহমেদ বাবুল, এমডি আবুল এহতেশাম আবদুল মোহাইমিন, পরিচালক ইউনুছ আহমদ, এম এ সবুর, আসিফুজ্জামান চৌধুরী, হাজী আবু কালাম, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, রোকসানা জামান চৌধুরী, বশির আহমেদ, সৈয়দ কামরুজ্জামান, মো. শাহ আলম, শরীফ জহির ও ড. সেলিম মাহমুদ। সাথে রয়েছেন ব্যাংকের ৫ জন সাবেক কর্মকর্তা ও প্রগ্রেসিভ ট্রেডিংয়ের মালিক মোহাম্মদ হোছাইন চৌধুরী, ইম্পেরিয়াল ট্রেডিংয়ের মালিক আব্দুল আজিজ এবং আরামিটের পিয়ন মো. ইয়াছিনুর রহমান।
এর আগে ৩০ জুলাই ‘রিলায়েবল ট্রেডিং’ নামে আরেকটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ১৫ কোটি টাকা, ২৪ জুলাই ‘ভিশন ট্রেডিং’-এর নামে ২৫ কোটি টাকা এবং ১৭ এপ্রিল ‘ইম্পেরিয়াল ট্রেডিং’, ‘ক্লাসিক ট্রেডিং’ ও ‘মডেল ট্রেডিং’-এর নামে ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাইফুজ্জামান দম্পতির বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করে দুদক। সাইফুজ্জামান ও তার স্ত্রীর নামে যুক্তরাজ্যে ৩৪৩টি, আমিরাতে ২২৮টি ও যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি বাড়ি-অ্যাপার্টমেন্টসহ অন্যান্য দেশে থাকা সম্পত্তি ফ্রিজের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গত ৫ মার্চ আদালত তাদের নামে থাকা ৩৯টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ দেন। এসব হিসাবে জমা রয়েছে প্রায় ৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। একইসঙ্গে তাদের নামে থাকা ১০২ কোটি টাকার শেয়ার ও ৯৫৭ বিঘা জমি জব্দ করা হয়। ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর তাদের দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত।

