লাতিন আমেরিকায় একাধিক সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান আইনি জটিলতায় পড়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহার।
ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো, কলম্বিয়ার আলভারো উরিবে, আর্জেন্টিনার ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ ডি কির্চনার ও ইকুয়েডরের রাফায়েল কোরেয়া এই তালিকার শীর্ষে। পেরুর সাতজন সাবেক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিচারের প্রক্রিয়া চলছে। তবে শুধু এই দেশ নয়। গুয়েমালা, কোস্টারিকা, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়া, পানামা, হন্ডুরাসসহ আরও কয়েকটি দেশে সাবেক নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রবণতা নির্দেশ করছে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা সমাপ্তির পর নেতাদের জন্য আইনি দায় এড়ানো সম্ভব নয়। দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারাধীন থাকছে।

এই পরিস্থিতি লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলছে। সাবেক নেতাদের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুধু আইনি নয়, এটি দেশের রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও জনগণের আস্থা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো সামরিক অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ২৭ বছরের বেশি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। তবে তিনি লাতিন আমেরিকার প্রথম নেতা নন, যিনি ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর আইনের মুখোমুখি হয়েছেন। বরং এই অঞ্চলে সাবেক নেতাদের বিচার কার্যক্রম যেন সাধারণ এক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেরুতে চারজন সাবেক প্রেসিডেন্ট বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। কলম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট আলভারো উরিবে ১২ বছরের গৃহবন্দিত্বের সাজা পেয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, লাতিন আমেরিকার প্রায় প্রতিটি দেশে অন্তত একজন সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিচারাধীন। এই প্রবণতা রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়—ক্ষমতা সমাপ্তির পরও নেতা আইনের বাইরে থাকতে পারেন না। আইনি প্রক্রিয়া শুধু ব্যক্তিগত দায়মুক্তির বিষয় নয়, এটি দেশের রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও জনগণের আস্থা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখছে।
লাতিন আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানদের আইনি ঝুঁকি: কারা কারা পড়েছেন বিচার কার্যক্রমে:
লাতিন আমেরিকায় ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানদের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম যেন নিয়ম হয়ে গেছে। সম্প্রতি ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো সামরিক অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রের দায়ে ২৭ বছরের বেশি কারাদণ্ড পেয়েছেন। তবে অন্য অনেক নেতা আগে থেকেই আইনের মুখোমুখি হয়েছেন।

ইকুয়েডরে ১৯৯৬ সাল থেকে নির্বাচিত ৮ জন নেতার মধ্যে একজন ছাড়া সবাই তদন্তের আওতায় এসেছেন। এর মধ্যে তিনজন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়া ঘুষের মামলায় দণ্ডিত হয়ে বর্তমানে বেলজিয়ামে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন। পেরুর চিত্রও মিল রয়েছে। ২০০০ সাল থেকে সাতজন প্রেসিডেন্ট দুর্নীতি বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বিচারাধীন হয়েছেন। এমনকি একজন পুলিশি ঘেরাওয়ের মুখে আত্মহত্যা করেছেন।
এল সালভাদর, মেক্সিকো, গুয়েতেমালা ও আর্জেন্টিনায় পাঁচজন করে সাবেক প্রেসিডেন্ট ফৌজদারি তদন্তের মুখে পড়েছেন। আর্জেন্টিনার ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ ডি কির্চনারকে ২০২২ সালে প্রতারণামূলক প্রশাসনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে গৃহবন্দি করা হয়েছে। গুয়েতেমালায়ও তিনজন সাবেক নেতা দণ্ডিত হয়েছেন। কোস্টারিকা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়া, পানামা, হন্ডুরাসসহ আরও কয়েকটি দেশে সাবেক নেতাদের বিরুদ্ধে গুরুতর তদন্ত চলছে। এর ফলস্বরূপ অনেকেরই কারাদণ্ড হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই প্রবণতা দেখাচ্ছে যে লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতা সমাপ্তির পরও নেতাদের আইনের বাইরে থাকা কঠিন। এই বিচার কার্যক্রম শুধু দোষীদের শাস্তি দেয় না, দেশের রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
একমাত্র ব্যতিক্রম উরুগুয়ে:
লাতিন আমেরিকায় ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানদের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম যেন নিয়মিত ঘটনা। তবে এই হতাশাজনক চিত্রের মধ্যে ব্যতিক্রম হিসেবে দাঁড়িয়েছে উরুগুয়ে। দেশটির গণতান্ত্রিক যুগে একজনও প্রেসিডেন্ট বিচার ব্যবস্থার দ্বারা অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্ত হননি। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে কোনো খোলা তদন্তও নেই। ‘দি ইকোনমিস্ট’-এর ২০২৪ সালের গণতন্ত্র সূচকে উরুগুয়েকে বিশ্বের ১৫তম এবং এই অঞ্চলের একমাত্র ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
উরুগুয়ের ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাঞ্জেল আরেলানো মনে করেন, দেশটির এই অবস্থানের মূল কারণ হলো ‘জনসম্পদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের রাজনৈতিক সংস্কৃতি’। তিনি বলেন, “(উরুগুয়েতে) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সাধারণত নিজের গাড়ি ব্যবহার করেন এবং সাধারণ বাড়িতে বসবাস করেন। তাদের খুব বেশি সুযোগ-সুবিধা নেই, বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায়, এবং তাদের কার্যক্রমে এক ধরনের কঠোরতা দেখা যায়।”
আরেলানো আরও বলেন, “একজন মন্ত্রীর এক অফিস থেকে অন্য অফিসে হেঁটে যাওয়া, নিজের গাড়ি চালিয়ে যাওয়া, কিংবা সংসদ সদস্যের নিজের গাড়ি চালিয়ে সংসদে যাওয়া সাধারণ ঘটনা। কোনো চালক, সচিব বা হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয় না।” এই চিত্র পেরুর মতো দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক দেশগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত, যেখানে গণতন্ত্র সূচকে তারা ৭৮তম স্থানে রয়েছে।
লাতিন আমেরিকার নেতাদের আইনি জটিলতার পেছনে দুটি প্রধান কারণ কাজ করে বলে মনে করা হয়: কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি এবং জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থার অভাব। ২০২৪ সালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্ট অনুযায়ী, আমেরিকার গড় স্বচ্ছতার স্কোর ৪২ (১০০-এর মধ্যে), যা ইউরোপের তুলনায় অনেক কম। আরেলানো যুক্ত করেন, এই দুর্নীতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, “লাতিন আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সংস্কৃতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতার এই কেন্দ্রীভূতকরণ সাবেক নেতাদের আইনি জটিলতার একটি বড় কারণ।”
লাতিন আমেরিকায় সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানদের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম ক্রমশ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি একদিকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন, অন্যদিকে জনগণের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দাবির ফল। ল্যাটিন আমেরিকার বিচার ও রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ম্যানুয়েল বালান তার ২০১৮ সালের গবেষণায় দেখিয়েছেন, “১৯৮০-এর দশকের গণতান্ত্রিকীকরণের পর থেকে প্রেসিডেন্টদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রবণতা বাড়ছে।”
আর্জেন্টিনার ইউনিভার্সিদাদ তোরকুয়াতো ডি তেল্লার পরিচালক ক্যাটালিনা স্মুলোভিৎজ বলেন, দুর্নীতির পরিসংখ্যান প্রায়শই মানুষের ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। তিনি বলেন, “কয়েক বছর আগেও দুর্নীতি জনমানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করত না, তাই ঘটনা বেড়েছে কি না তা নির্ধারণ করা কঠিন। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ এটিকে সমস্যা হিসেবে দেখেনি, তাই দুর্নীতির হার কম দেখানো হতে পারে।”
স্মুলোভিৎজ আরও উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এখন ‘ল-ফেয়ার’ (আইনি লড়াইকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার) ব্যবহার করে বিরোধীদের চুপ করাতে ভিত্তিহীন অভিযোগের আশ্রয় নেয়। তিনি সতর্ক করেন, কর্মকর্তারাও প্রায়শই নিজেদের বিরুদ্ধে ‘ল-ফেয়ার’ হচ্ছে বলে দাবি করে তদন্ত এড়াতে চান। এতে বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা দুর্বল হতে পারে।
উরুগুয়ের অধ্যাপক অ্যাঞ্জেল আরেলানো এই প্রসঙ্গে বলেন, “জনসম্পদের তদারকি পশ্চিমা উদার গণতন্ত্রের একটি মূল বৈশিষ্ট্য। তাই আইনি জটিলতা কম হওয়া উন্নতির লক্ষণ নয়; বরং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই আসল লক্ষ্য।” বিশ্লেষকরা মনে করেন, লাতিন আমেরিকার এই আইনি জটিলতা শুধুই নেতাদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য নয়। এটি রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ ও জনগণের আস্থাকে প্রভাবিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন।