সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় পরিচালনায় পরামর্শ দিতে একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব উঠেছে। প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে এই কমিশনে থাকবেন আইনমন্ত্রী বা উপদেষ্টা, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এবং অ্যাটর্নি জেনারেল।
আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া নিয়ে আলোচনা হবে। বৈঠকটি রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকের সভাপতিত্ব করবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিচার প্রশাসনের বিশেষজ্ঞরা কমিশন গঠনের প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছেন। তাদের মতে, সংবিধান এবং মাসদার হোসেন মামলার আলোকে এমন কোনো কমিশন গঠনের সুযোগ নেই। তাদের প্রশ্ন, প্রশাসনের লোক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ে ঢুকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বজায় থাকবে কীভাবে?
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় বিচার বিভাগের আর্থিক ও বাজেট ব্যবস্থাপনা, পদায়ন-পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণসহ সব কাজ পরিচালনা করবে। এসব কাজের ক্ষেত্রে কমিশন পরামর্শ দেবে। আগের খসড়া অধ্যাদেশে বিচারকদের নিয়োগ-বদলি ও পদোন্নতি-সংক্রান্ত কমিটিতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে রাখার প্রস্তাবে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন আপত্তি জানিয়েছিল। পরে তা সংশোধন করে চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুত করা হয়।
বিএসজেএ-এর মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম বলেন, অধ্যাদেশ কার্যকর হলে বিচার বিভাগ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হবে। অধ্যাদেশ অনুমোদিত হলে একটি কমিশন গঠন হবে। কমিশনের কর্মপরিধি পরবর্তী বিধিমালার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। তিনি জানান, কমিশন আইনি ও বিধিবিধানের বিষয় নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়কে পরামর্শ দেবে।
অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ এবং বিসিএস বিচার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব মাসদার হোসেন কমিশন গঠনের প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কাজের জন্য পৃথক কোনো কমিশন গঠন সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলার আলোকে সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সচিবালয়ে প্রশাসনের লোক ঢোকালে স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে। মাসদার হোসেন মামলার আট দফা নির্দেশনা অনুযায়ী বিচার বিভাগকে প্রশাসন ও আইন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। কমিশনের নামে সচিবালয়ে সরকারের কোনো প্রতিনিধি রাখলে এটি সংবিধানের ২২ ধারার লঙ্ঘন হবে এবং মামলার আট দফা অবমাননা হিসেবে গণ্য হবে।
খসড়া অধ্যাদেশে কী আছে?
খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রধান বিচারপতির হাতে থাকবে। সচিব হবেন প্রশাসনিক প্রধান। সচিব পদে নিয়োগ পাবেন জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ। সচিব সরকারের জ্যেষ্ঠ সচিবের সমমর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করবেন। সচিবালয় গঠিত হবে নির্দিষ্ট বিধির মাধ্যমে। এতে একজন সচিব এবং অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয় থাকবে। অধ্যাদেশে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের মাধ্যমে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা আবশ্যক বলে বলা হয়েছে।
অধ্যাদেশে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মশর্ত নির্ধারণের বিধানও রাখা হয়েছে। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন বা বিধির ওপর এই অধ্যাদেশ প্রাধান্য পাবে। খসড়ায় সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণও দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের বিচার প্রশাসন পরিচালনায় সুপ্রিম কোর্টকে সহায়তা করা, অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করা হবে। সচিবালয় হাইকোর্ট বিভাগের অধীনে সব দেওয়ানি-ফৌজদারি আদালত ও ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা, ক্ষমতা ও গঠন নির্ধারণ করবে। এছাড়া, আদালত ও ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলি ঠিক করবে।
অধ্যাদেশে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, শৃঙ্খলা ও অন্যান্য বিষয়, অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ ও পদায়ন, বাজেট ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা তত্ত্বাবধান, প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণসহ সব সাচিবিক দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে।
১৮ বছর আগে পৃথক বিচার বিভাগ: বিচার বিভাগের স্বাধীনতার দীর্ঘ লড়াই:
বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়েছিল ২০০৭ সালে। সেই সময় লক্ষ্য ছিল, বিচার বিভাগ রাজনৈতিক বা অন্য কোনো প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার পরও সরকারের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিন ধরে উঠছে আইনজীবী ও অংশীজনদের মধ্যে। এই দাবিকে বাস্তবে রূপ দিতে ২০০৭ সালের পর অন্তর্বর্তী সরকার সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের উদ্যোগ নেয়।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতার পৃথকীকরণ সাংবিধানিকভাবে আরও শক্তিশালী হবে।”
এক বছর আগে পাঠানো হয়েছিল প্রস্তাব:
সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের প্রস্তাব গত বছরের ২৭ অক্টোবর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নির্দেশনায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন একটি ধারণাপত্রসহ প্রস্তাবটি তৈরি করে। পৃথক সচিবালয় গঠন বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের অন্যতম সুপারিশ ছিল। এই প্রেক্ষাপটে আইন মন্ত্রণালয় অধ্যাদেশ খসড়া করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আজ বৃহস্পতিবার এ অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদে তুলে আলোচনা করছে।
জুলাই সনদেও সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়:
জুলাই সনদের ৫২ নম্বর প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে কার্যকরভাবে পৃথক করতে সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব সচিবালয় গঠন করা হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে। বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সচিবালয়কে সংযুক্ত তহবিল থেকে অর্থায়ন দেওয়া হবে। এছাড়া সচিবালয় অধস্তন আদালতের প্রশাসনিক কার্যক্রম, বাজেট প্রণয়ন, বিচারকের পদোন্নতি, বদলি এবং শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব পালন করবে। সব রাজনৈতিক দল ও জোট এ বিষয়ে একমত হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয় পরিচালনা নিয়ে বিরোধ:
সুপ্রিম কোর্টের পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পর আইন ও বিচার বিভাগে প্রশাসন ক্যাডারের ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা কাজ করবেন। এ বিধান অনুযায়ী গত ২৮ জুলাই আইন ও বিচার বিভাগে পদায়ন বিধিমালা, ২০২৫-এর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তবে প্রশাসন ক্যাডারের সিনিয়র সহকারী সচিব ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের আইন উপকমিটির সদস্য তাজউদ্দিন আইন মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংস্থায় নির্বাহী পদে কর্মরত বিচারকদের বিচার বিভাগে প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছেন।
তাজউদ্দিন প্রধান উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব এবং লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিবের কাছে আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়েছে, আইন মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংস্থায় নির্বাহী পদে কর্মরত অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রত্যাহার করে তার স্থলে নির্বাহী বিভাগের আইন ডিগ্রিধারী কর্মকর্তাদের পদায়ন করতে হবে।
সরকার বনাম মাসদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তারা ফৌজদারি আদালতসহ বিচার বিভাগীয় সব দায়িত্ব পরিত্যাগ করেন কিন্তু তখন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা সরকারি ও নির্বাহী পদসমূহ পরিত্যাগ করেননি।