যুক্তরাষ্ট্রে গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রথমবারের মতো নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে একজন দণ্ডিত খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এটি দেশটিতে এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ঘটনা হিসেবে নজিরবিহীন।
জাপানে এক ব্যক্তিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আগুন জ্বালিয়ে ৩৬ জনকে হত্যা করেছিলেন। বাংলাদেশে গত বছরের জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গতকাল সোমবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ডের হার বাড়ছে। তবে অনেক দেশ এই শাস্তি আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যাক, কোন দেশগুলোতে বিভিন্ন অপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর রয়েছে এবং কোন দেশে এই শাস্তি বাতিল করা হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডের বিধান কত দেশে:
লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে মাত্র ৯টি দেশ ‘সবচেয়ে গুরুতর’ অপরাধে যেমন একাধিক খুন বা যুদ্ধাপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর রেখেছে। একই সঙ্গে ২৩টি দেশ মৃত্যুদণ্ড আইনে রাখলেও গত ১০ বছরে একবারও তা প্রয়োগ করেনি।
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, পৃথিবীতে ৫৫টি দেশ ও অঞ্চলে মৃত্যুদণ্ড বৈধ। এর মধ্যে রয়েছে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, বাংলাদেশ, ইথিওপিয়া, জাপান, মিসর, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, ভিয়েতনাম, ইরান, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, সুদান, উগান্ডা, ইরাক, আফগানিস্তান, ইয়েমেন, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া ও তাইওয়ান। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকারী দেশ। দেশটিতে প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে চীন এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রকাশ না করায় সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব নয়।
অন্যান্য দেশ, যেখানে মৃত্যুদণ্ড বৈধ, তারা হলো সোমালিয়া, জিম্বাবুয়ে, দক্ষিণ সুদান, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কিউবা, বেলারুশ, লিবিয়া, সিঙ্গাপুর, লেবানন, ফিলিস্তিন, ওমান, কুয়েত, কাতার, জ্যামাইকা, গাম্বিয়া, বতসোয়ানা, লেসোথো, বাহরাইন, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, কোমোরস, গায়ানা, বেলিজ, বাহামাস, বার্বাডোস, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রানাডাইনস, অ্যান্টিগুয়া ও বার্বুডা, ডোমিনিকা এবং সেন্ট কিটস ও নেভিস।
প্রতিবছর কতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়:
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সরকারি পরিসংখ্যান, সংবাদমাধ্যম ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পরিবার ও প্রতিনিধিদের তথ্য মিলিয়ে হিসাব তৈরি করেছে। সংস্থার ধারণা, চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকারী দেশ। দেশটিতে প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে চীন এ-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ না করায় সঠিক সংখ্যা জানা সম্ভব নয়।
চীন ছাড়া ২০২২ সালে বিশ্বে ৮৮৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এটি ২০১৭ সালের পর সবচেয়ে বেশি। তবে ১৯৮৮, ১৯৮৯ ও ২০১৫ সালের সঙ্গে তুলনা করলে সংখ্যা অনেক কম। ওই বছরগুলিতে প্রতিবছর ১ হাজার ৫০০-এর বেশি মানুষ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। অ্যামনেস্টির হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে অন্তত ২ হাজার ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, ৫২টি দেশে। একই বছরে বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীর সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ২৮২। অনেকে বছরের পর বছর, কখনো কখনো দশক ধরে কনডেমড সেলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন।
মৃত্যুদণ্ড সবচেয়ে বেশি কার্যকর করা দেশ:
২০২২ সালে বিভিন্ন অপরাধে ২০টি দেশ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৮। চীন ছাড়া সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে ইরান, সৌদি আরব, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্র। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে, ২০২২ সালে ইরানে কমপক্ষে তিনটি প্রকাশ্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এছাড়া দেশটি পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, যাদের অপরাধ সংঘটিত করার সময় বয়স ছিল ১৮ বছরের কম।
নিয়মিত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেশ:
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১১টি দেশ নিয়মিতভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। এর মধ্যে রয়েছে চীন, মিসর, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম ও ইয়েমেন। সংস্থাটি মনে করে, উত্তর কোরিয়াও ধারাবাহিকভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে; যদিও তা যাচাই করা যায়নি।
সৌদি আরব ২০২২ সালে বিগত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। অন্যদিকে, বাহরাইন, কমোরস, লাওস, নাইজার ও দক্ষিণ কোরিয়া—এই পাঁচ দেশে কিছু বছর ব্যবহার না হলেও ২০২২ সালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০২১ সালের তুলনায় মৃত্যুদণ্ড বেড়েছে। তবে তা এখনও ১৯৯৯ সালের সর্বোচ্চ সংখ্যার অনেক নিচে রয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডের পেছনে কাজ করা গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ:
যেসব গুরুতর অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তার মধ্যে মাদক–সংক্রান্ত অপরাধ অন্যতম। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে মাদকসংক্রান্ত অপরাধে ৩২৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫৫ জন ইরানে, ৫৭ জন সৌদি আরবে ও ১১ জন সিঙ্গাপুরে।
বিশ্বের ১১টি দেশ নিয়মিতভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। এর মধ্যে রয়েছে চীন, মিসর, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম ও ইয়েমেন। অ্যামনেস্টি মনে করে, উত্তর কোরিয়াও ধারাবাহিকভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে; যদিও তা যাচাই করা যায়নি। ২০২৩ সালে সিঙ্গাপুর প্রায় ২০ বছর পর প্রথমবারের মতো একজন নারী অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। সারিদেভি জামান নামের এ নারী ২০১৮ সালে হেরোইন পাচারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন।
মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে কারা:
২০২২ সালে ১১২টি দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি। ১৯৯১ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৮। ২০২২ সালে ছয়টি দেশ মৃত্যুদণ্ড আংশিক বা পুরোপুরি বাতিল করেছে। কাজাখস্তান, পাপুয়া নিউগিনি, সিয়েরা লিওন ও মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র মৃত্যুদণ্ড পুরোপুরি বাতিল করেছে। ইকুয়েটোরিয়াল গিনি ও জাম্বিয়া মৃত্যুদণ্ড শুধুমাত্র ‘সবচেয়ে গুরুতর’ অপরাধে প্রযোজ্য করার ঘোষণা দিয়েছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে মালয়েশিয়ার সংসদ ১১টি গুরুতর অপরাধে বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড তুলে দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে। একই বছরের জুলাইয়ে ঘানার সংসদ মৃত্যুদণ্ড বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়।
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ড বাতিল করা দেশগুলো হলো মেক্সিকো, ফিলিপাইন, তুরস্ক, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইতালি, কলম্বিয়া, স্পেন, আর্জেন্টিনা, কানাডা, অ্যাঙ্গোলা, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, উজবেকিস্তান, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার, আইভরিকোস্ট, নেপাল, ভেনেজুয়েলা, অস্ট্রেলিয়া, চাদ, কাজাখস্তান, সেনেগাল, রোমানিয়া, নেদারল্যান্ডস, ইকুয়েডর, কম্বোডিয়া, গিনি, বেনিন, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি, বলিভিয়া, হাইতি, বেলজিয়াম, ডোমিনিকান রিপাবলিক, হন্ডুরাস, পাপুয়া নিউগিনি, সুইডেন, চেকিয়া।
অন্যান্য দেশগুলো হলো পর্তুগাল, আজারবাইজান, গ্রিস, টোগো, হাঙ্গরি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, সিয়েরা লিওন, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান, প্যারাগুয়ে, নিকারাগুয়া, বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, কোস্টারিকা, পানামা, ক্রোয়েশিয়া, জর্জিয়া, মঙ্গোলিয়া, উরুগুয়ে, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, নামিবিয়া, মলদোভা, আর্মেনিয়া, লিথুয়ানিয়া, আলবেনিয়া, গ্যাবন, গিনি-বিসাউ, স্লোভেনিয়া, লাটভিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, তিমুর-লেস্তে।
অন্য দেশগুলো হলো সাইপ্রাস, এস্তোনিয়া, মরিশাস, জিবুতি, ফিজি, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ভুটান, লুক্সেমবার্গ, সুরিনাম, মন্টেনেগ্রো, মাল্টা, কেপ ভার্দে, আইসল্যান্ড, ভানুয়াতু, সাওতমে ও প্রিন্সিপে, সামোয়া, কিরিবাতি, সেশেলস, মাইক্রোনেশিয়া, অ্যান্ডোরা, লিচেনস্টেইন, মোনাকো, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, সান মারিনো, পালাউ, কুক দ্বীপপুঞ্জ, নাউরু, টুভালু, নিউই এবং ভ্যাটিকান সিটি।
বিশ্বে কীভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়:
২০২২ সালে সৌদি আরব একমাত্র দেশ, যেখানে শিরশ্ছেদকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যান্য দেশে ব্যবহৃত পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে ফাঁসি, প্রাণনাশী ইনজেকশন ও গুলিতে মৃত্যুদণ্ড। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা অঙ্গরাজ্যে কেনেথ স্মিথ নামের এক খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে। ডেথ পেনাল্টি ইনফরমেশন সেন্টারের মতে, এটি বিশ্বে প্রথমবারের মতো এ পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার ঘটনা। স্মিথের আইনজীবীরা এই পরীক্ষাহীন পদ্ধতিকে ‘নিষ্ঠুর ও অস্বাভাবিক’ বলে অভিহিত করেছেন। আলাবামাসহ যুক্তরাষ্ট্রের আরও দুটি অঙ্গরাজ্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করার অনুমোদন দিয়েছে। দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার হার কমে যাওয়ার অন্যতম বড় কারণ হলো প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকট।
মৃত্যুদণ্ড বিশ্বজুড়ে একটি বিতর্কিত ও সংবেদনশীল বিষয়। কিছু দেশে এটি অপরাধ দমন ও ন্যায়বিচারের হাতিয়ার হিসেবে কার্যকর হচ্ছে, আবার অনেক দেশে মানবাধিকারের কারণে বাতিল করা হয়েছে। সংখ্যা, দেশ, পদ্ধতি ও প্রয়োগের পার্থক্য দেখায়, মৃত্যুদণ্ডের বাস্তব চিত্র অত্যন্ত জটিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কার্যকরী ব্যবস্থা ও পরিবর্তনের ধারা বোঝার মাধ্যমে আমরা আইন, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের মধ্যে সূক্ষ্ম সীমানা স্পষ্টভাবে দেখতে পারি।

