আদালত আইনানুগভাবে কতটুকু কাজ করবে তা অনেকাংশেই নির্ভর করে বিজ্ঞ আইনজীবীদের পেশাগত নৈতিকতা ও আইনী প্রজ্ঞার ওপর। যদি একজন আইনজীবী আইনী প্রজ্ঞা ছাড়া আদালতে প্রবেশ করেন, তাহলে তিনি তার মক্কেলের জন্য প্রতিকার চাইতে অযথা শব্দপ্রয়োগ, গলাবাজি বা এমনকি শারীরিক শক্তি ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারেন।
আইনাঙ্গন একটি জটিল প্রতিষ্ঠান। এখানে পুলিশ, আইনজীবী, আইনজীবী-সহকারী, বিচারক এবং আদালতের কর্মচারী প্রত্যেকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রতিষ্ঠান আইনানুগভাবে কতটা কাজ করবে তা নির্ভর করে এই পেশার মানুষগুলো কতটা দক্ষভাবে কাজ করতে পারেন।
গত দশ বছরে বার কাউন্সিল পরীক্ষার আয়োজনে ধীরগতি হলেও পরীক্ষাগুলি মানসম্পন্ন ছিল, আগের দশকের তুলনায় অনেক ভালো। এর ফলে আদালতে কিছু তরুণ আইনজীবী তাদের দক্ষতার ছাপ রাখতে শুরু করেন। যদি আইনজীবী দক্ষ হন, বিচারকাজ সহজ হয়ে যায়। বিচারক আইনের দিশা পায় আইনজীবীর কাছ থেকে। আইনজীবী তালিকাভুক্তিতে যদি আইনী দক্ষতার প্রতিফলন না থাকে, তবে এর খারাপ প্রভাব পড়ে আদালতের কার্যক্রমে।
বাংলাদেশে আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হলো বার কাউন্সিল। (জেলার বার অ্যাসোসিয়েশন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান)। বার কাউন্সিল নির্বাচিত হন আইনজীবীদের ভোটে, তবে চেয়ারম্যান পদাধিকার অনুযায়ী অ্যাটর্নি জেনারেল। ২০১২ সালে আইন সংশোধনের মাধ্যমে বার কাউন্সিলের সাচিবিক কাজ তদারকি করার জন্য একজন জেলা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে সচিব হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
আইনজীবী তালিকাভুক্তির মান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ২০১২ সালে একটি পৃথক কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রধান হচ্ছেন আপীল বিভাগের একজন বিচারপতি। এখানে একটু আইরনি লক্ষ্য করার বিষয় আছে। বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদে আছেন অ্যাটর্নি জেনারেল, যিনি পদমর্যাদায় হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতির সমান। আবার এই প্রতিষ্ঠানের একটি কমিটির চেয়ারম্যান পদে আছেন আপীল বিভাগের একজন বিচারপতি। প্রশ্ন আসে, কে উপরে? অ্যাটর্নি জেনারেল নাকি আপীল বিভাগের বিচারপতি?
বার কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্যরা ও চেয়ারম্যান অ্যাটর্নি জেনারেল স্বীকার করেন, এই প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক প্রভাবের অধীনে আছে। তাঁরা রাজনৈতিক সংগঠন বা নির্দিষ্ট পক্ষের সঙ্গে যুক্ত। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের জন্য তাঁদের কাছে অ্যাপ্রোচ করা সহজ। আইনজীবী নেতারা সাংগঠনিক হওয়ায় সাধারণভাবে কারও জন্য দরজা বন্ধ রাখা সম্ভব হয় না। ফলে আইনজীবী তালিকাভুক্তিতে মানহীন প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু নামমাত্র ল গ্র্যাজুয়েট তদ্বির করতে নেতাদের দ্বারস্থ হন। এটি স্বাভাবিক ঘটনা। সুপ্রীম কোর্ট ইতোমধ্যেই মানহীন ‘ল’ কলেজগুলোর মানোন্নয়নের নির্দেশ দিয়েছে। তবুও এই ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা যায়নি। ফলে অদক্ষ ব্যক্তিরা আইনজীবী তালিকাভুক্তির জন্য তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছেন।
বার কাউন্সিলের ভেতরের পরিস্থিতিও জটিল। পুরো কাউন্সিল আইনজীবী নেতাদের নিয়ন্ত্রণে। পাশাপাশি একটি কমিটির—(এনরোলমেন্ট কমিটি) চেয়ারম্যান হলেন আপীল বিভাগের বিচারপতি।। ২০১২ সালে কমিটি গঠনের পর থেকে এই প্রতিষ্ঠানে তালিকাভুক্তি নিয়ে ইন্টারনাল টেনশন কতদূর, তা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই বলতে পারবেন।
একদিকে আইনজীবী নেতারা আছেন, যাঁদের কাছে সবাই তদ্বির করতে পারেন এবং যারা নেতা হওয়ায় সুপারিশ না করতে পারেন না। অন্যদিকে কমিটিতে তিনজন বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং একজন আইনজীবী মেম্বার রয়েছেন। তালিকাভুক্তির পরীক্ষা আয়োজনের ধীরগতি এটি স্পষ্ট করে। ২০১২ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত এই কমিটি গড়ে এভারেজ তিন বছর পরপর পরীক্ষা আয়োজন করতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে স্ট্যান্ডার্ড হলো প্রতিবছর দুইবার পরীক্ষা। বোঝাই যাচ্ছে, কার্যক্রমের গতি কতটা ধীর।
এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার সহজ উপায় নেই। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—আইনজীবী নেতাদের তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা না হলে মেধার ভিত্তিতে তালিকাভুক্তি সম্ভব নয়। এর সমাধান হতে পারে তালিকাভুক্তি সম্পূর্ণভাবে সুপ্রীম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করা। একইসাথে আইনজীবীদের শৃঙ্খলাও সুপ্রীম কোর্টের তত্ত্বাবধানে আনা জরুরি। এটি করতে আইনী কাঠামোতে বড় পরিবর্তন প্রয়োজন। এটি বাস্তবায়িত হবে কি না বলা মুশকিল। তবে এখানে কার কনসার্ন, কোন প্রেশার গ্রুপ সক্রিয়, তা আন্দাজ করা তেমন কঠিন নয়।
নেতৃত্ব ও প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে আইনজীবী তালিকাভুক্তি কেবল রাজনৈতিক প্রভাবের খেলা হয়ে থেকে যায়। মেধা ও ন্যায়ের সঠিক প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হলে পুরো প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হতে হবে।

