কক্ষের একটি চেয়ারে চুপচাপ বসেছিলেন ২২ বছরের এক তরুণী। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। ছোট এক মেয়েশিশু তাঁর চারপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। সময় তখন বেলা সোয়া ১১টা। কক্ষজুড়ে ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মতো।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা জেলা আদালতের লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে এই প্রতিবেদক তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তরুণী জানান, তিনি জেলার আশাশুনি উপজেলা থেকে দেনমোহর ও ভরণপোষণের জন্য এখানে এসেছেন। আট বছর আগে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তাঁর বিয়ে হয়েছিল। বর্তমানে তাঁর একমাত্র সন্তান পাঁচ বছরের। চার দিন আগে স্বামী তাঁকে তালাকের নোটিশ পাঠিয়েছে। তরুণী জানালেন, স্বামী বছরে ছয় মাস ইটভাটায় কাজ করেন এবং বাকি ছয় মাস কোনো কাজ করেন না। ‘আমাকে নির্যাতন করা ওর অভ্যাস। বিয়ের পর থেকে কখনো মেয়ের খরচ বা আমার খরচ দেয়নি, বললেন তিনি। গতকাল ২৫ নভেম্বর (মঙ্গলবার) শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধপক্ষ। ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করা হবে এই পক্ষ।
সাতটি আইনে মামলার আগে মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক করার জন্যই তাঁকে লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে যেতে হয়েছে। এই বিধান এসেছে আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর মাধ্যমে। যেসব ধারায় এটি প্রযোজ্য, তার একটি হলো পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, ধারা ৫। এখন পর্যন্ত সংশোধিত অধ্যাদেশ ১২টি জেলায় কার্যকর হয়েছে। এগুলো হলো ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, রংপুর, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাঙামাটি, সিলেট, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ।
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, অধ্যাদেশ কার্যকর হওয়ার পর ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত দুই মাসে ১২টি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে নারীদের অভিযোগের স্তূপ জমেছে। সাতটি আইনের বিভিন্ন ধারায় মোট আবেদন এসেছে ৫,৯১৬টি। এর মধ্যে ৫,১২৫টি অর্থাৎ প্রায় ৮৭ শতাংশ আবেদন পারিবারিক ও যৌতুক সংক্রান্ত। মোট অভিযোগের মধ্যে ৩,০৪১টি বা ৫১ শতাংশ নিষ্পত্তি হয়েছে। গতকাল থেকে শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধপক্ষ, যা ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করা হবে। অন্তর্বর্তী সরকার আইনগত সহায়তা প্রদান আইন সংশোধন করে ৯টি আইনের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক করেছে। এটি ১ জুলাই ২০২৫ তারিখে অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়।
কোন আইনে কত অভিযোগ:
সাতক্ষীরা জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে যেসব আইনের ওপর অভিযোগ নেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে দুটি আইনের ভুক্তভোগীরা নারী। এর একটি হলো পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩–এর ধারা ৫। এই ধারায় বলা হয়েছে, মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান অনুসারে পারিবারিক আদালত বিবাহবিচ্ছেদ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, দেনমোহর, ভরণপোষণ এবং শিশুসন্তানদের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধানে মোকদ্দমা গ্রহণ, বিচার ও নিষ্পত্তি করার এখতিয়ার রাখে।
সংশোধিত অধ্যাদেশ অনুযায়ী, এসব বিষয়ে মামলা করার আগে লিগ্যাল এইডে মধ্যস্থতার আবেদন বাধ্যতামূলক। পারিবারিক আদালত আইনের ৫ ধারায় ২,৬৫৬টি আবেদন জমা হয়েছে। যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ৩ ধারা (যৌতুক দাবি করার দণ্ড) ও ৪ ধারা (যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ) মিলিয়ে ২,৪৬৯টি আবেদন এসেছে।
অন্য আইনের ভিত্তিতে আবেদনগুলো হলো:
- বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ – উল্লিখিত বিরোধ ধারায় ১৩টি,
- সহকারী জজ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত বণ্টন সম্পর্কিত বিরোধ – ১৩টি,
- স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০ – ৯৬ ধারায় ১৩৩টি,
- নন-অ্যাগ্রিকালচারাল টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৪৯ – ২৪ ধারায় ১৭টি,
- পিতা–মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ – ৮ ধারায় ১৪টি।
সাতক্ষীরা জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা (বিচারক) লিটন দাশ জানান, আপস-মীমাংসা ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে সফল হচ্ছে। যেসব অভিযোগে আপস সম্ভব হচ্ছে না, তাদের ‘মধ্যস্থতা ব্যর্থ সনদ’ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
নারীদের কান্না ও হতাশায় মধ্যস্থতা কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ:
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার এক ১৯ বছরের তরুণী যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ৩ ও ৪ ধারায় স্বামী ও শ্বশুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে ২১ সেপ্টেম্বর লিগ্যাল এইডে মধ্যস্থতার আবেদন করেন। তরুণীর বড় বোন ২২ নভেম্বর জানান, স্বামী ও শ্বশুর নিয়মিত ১০–২০ হাজার টাকা যৌতুক দাবি করতেন। লিগ্যাল এইডে অভিযোগ করার পর ৬ অক্টোবর মীমাংসা ও বিরোধ নিষ্পত্তির দিন ধার্য করা হয়। প্রথম বৈঠকে স্বামী হাজির হননি। ১৫ দিন পর দ্বিতীয় বৈঠকে স্বামী উপস্থিত হন। পরে মীমাংসা সম্পন্ন হয়। তরুণীকে সংসারে ফিরিয়ে দিয়েছেন স্বামী এবং লিগ্যাল এইড কর্মকর্তাদের কাছে অঙ্গীকার করেছেন, আর কখনো ঝামেলা করবেন না।
সাতক্ষীরা সদরের এক নারীও ২২ নভেম্বর জানান, স্বামীর বিরুদ্ধে ভরণপোষণ না দেওয়ার অভিযোগ জানিয়ে তিনি ২১ সেপ্টেম্বর লিগ্যাল এইডে আবেদন করেছিলেন। তাঁর দুই সন্তান রয়েছে। স্বামী তাঁর অনুমতি ছাড়াই চার বছর আগে মুন্সিগঞ্জে আরেকটি বিয়ে করেছেন এবং দোকান চালান। নারী বলেন, ১২ অক্টোবর মীমাংসা বৈঠকে স্বামী উপস্থিত হন এবং ভরণপোষণ দেওয়ার অঙ্গীকার করেন কিন্তু পরিবারের কাছ থেকে ১৩ হাজার টাকা নিয়ে চলে গেছেন। এরপর তাঁরা আর কোনো খোঁজ পাননি। কথা বলতে গিয়ে চল্লিশোর্ধ্ব নারী কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘ছেলেকে নিয়ে আমি কী যে কষ্ট করি! অন্যের বাড়িতে কাজ করি, পরিশ্রমে শরীর ভেঙে আসে।’
সাতক্ষীরা জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা (বিচারক) লিটন দাশ বলেন, আপস-মীমাংসা ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে সফল হচ্ছে। যেসব অভিযোগে মীমাংসা সম্ভব হচ্ছে না, তাদের ‘মধ্যস্থতা ব্যর্থ সনদ’ দেওয়া হচ্ছে। ওই সনদ দেখিয়ে ভুক্তভোগীরা মামলা করতে পারবেন। পারিবারিক আদালত ও যৌতুক সংক্রান্ত অভিযোগে মীমাংসা বেশি হচ্ছে।
আইন বিশ্লেষক ও সাবেক জেলা জজ ফউজুল আজিম বলেন, অর্ধেক সংখ্যক মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া দেখায় লিগ্যাল এইডের মামলাপূর্ব মধ্যস্থতার উদ্যোগ এখনও কার্যকর হয়নি। একই রকম চিত্র দেখা যেত পারিবারিক আদালত ও দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতে। তিনি সতর্ক করে বলেন, সময় গেলে লিগ্যাল এইডের ওপর এসব মামলার চাপ আরও বাড়বে।
মধ্যস্থতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া:
অন্তর্বর্তী সরকার ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন’ সংশোধন করে ৯টি আইনের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক করেছে। এটি ১ জুলাই ২০২৫ তারিখে অধ্যাদেশ আকারে জারি হয়। আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ অনুযায়ী, নির্দিষ্ট ধারার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে প্রথমে লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির আবেদন করতে হবে। মধ্যস্থতা ব্যর্থ হলে আদালতে মামলা করা যাবে। মধ্যস্থতার দায়িত্ব পালন করবেন চিফ লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা, লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা বা প্রয়োজন অনুযায়ী স্পেশাল মেডিয়েটর।
সরকার ১৫ সেপ্টেম্বর গেজেট প্রকাশ করে এবং ১৭ সেপ্টেম্বর বিধিমালা জারি করে। বিধিমালা অনুযায়ী, ২১ কার্যদিবসের মধ্যে মধ্যস্থতা কার্যক্রম শেষ করতে হবে। তবে নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্টস অ্যাক্ট, ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারা (৫ লাখ টাকার চেক ডিজঅনার অভিযোগ) মতো কিছু ক্ষেত্রে মামলার অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হবে বলে লিগ্যাল এইড কর্মকর্তারা মত দিলে তা মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
সংশোধিত অধ্যাদেশটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ১১(গ) ধারার (যৌতুকের কারণে সাধারণ জখম) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। তবে নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তাদের বক্তব্য, ফৌজদারি অপরাধে কোনো নারীকে অভিযোগের আগে অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে আপসের আলোচনায় বাধ্য করা অগ্রহণযোগ্য। ফলে, নারী ও শিশু বিষয়ক দুটি আইনের মধ্যস্থতা বাদ দিয়ে বর্তমানে সাতটি আইনের ক্ষেত্রে ১২ জেলায় মধ্যস্থতা কার্যকর রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা (বিচারক) লিটন দাশ বলেন, “নারীরা মধ্যস্থতা করতে চান, কিন্তু বিশ্বস্ত জায়গা পান না। মামলার আগে মধ্যস্থতার এই প্রক্রিয়া খুব জরুরি। তবে এটিকে কার্যকর করার জন্য লিগ্যাল এইড অফিসে জনবল বাড়াতে হবে।”
প্রস্তুতি না থাকলে সফলতা আসবে না:
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করা জরুরি। এসডিজির ৫ ও ১৬ নম্বর লক্ষ্য নারীসহিংসতা বন্ধ ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ওপর জোর দেয়। ৫ নম্বর লক্ষ্য অনুযায়ী, নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে হবে, ক্ষতিকর প্রথা দূর করতে হবে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের সব ক্ষেত্রেই নারীদের পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ১৬ নম্বর লক্ষ্য অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা, সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা জরুরি।
আইন বিশ্লেষক ও সাবেক জেলা জজ ফউজুল আজিম বলেন, “অর্ধেক সংখ্যক মামলারই নিষ্পত্তি না হওয়া দেখায় লিগ্যাল এইডের মামলাপূর্ব মধ্যস্থতার উদ্যোগ খুব কার্যকর হয়নি। একই রকম চিত্র দেখা যায় পারিবারিক আদালত ও দেওয়ানি বা ফৌজদারি আদালতে। সময়ের সঙ্গে লিগ্যাল এইডের ওপর মামলার চাপ আরও বাড়বে। এর জন্য দক্ষতা ও প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মধ্যস্থতাকারী তৈরি করা জরুরি।”
সাতক্ষীরা জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা (বিচারক) লিটন দাশ বলেন, “নারীরা মধ্যস্থতা করতে চান, কিন্তু বিশ্বস্ত জায়গা পান না। মামলার আগে মধ্যস্থতার এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটিকে কার্যকর করার জন্য লিগ্যাল এইড অফিসে জনবল বৃদ্ধি করা দরকার।”

