দেশের বিচার বিভাগে বড় সংখ্যায় পদোন্নতি হয়েছে। জেলা জজ, অতিরিক্ত জেলা জজ ও যুগ্ম জেলা জজ পদে একই দিনে গতকাল ৮২৬ জনকে পদোন্নতি ও পদায়ন করা হয়েছে। আমার অনেক বন্ধু বান্ধব, বড় ভাই, এমনকি কয়েক বছরের ছোট অনেকেও জেলা জজ হয়েছেন যেটা বিচারকদের বলতে গেলে সর্বোচ্চ পদোন্নতি। তাদের সবাইকে অভিনন্দন।
কিন্তু এই যে অতিরিক্ত জেলা জজ থেকে ২৫০ জন জেলা জজ হলেন তাদের বসার জায়গা থেকে শুরু করে সাপোর্ট স্টাফ পেশকার, নাজির, পিয়ন কিছু কী আছে? না থাকলে তারা বিচারিক সেবা দেবেন কী করে? প্রশ্ন হলো অবকাঠামোগত সমস্যাসহ নানা সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করতে না পারলে এই পদোন্নতি দিয়ে তো মামলাজট কমানো কিংবা ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা কঠিন তাই নয় কী?
কথাগুলো বলছি কারণ এই দেশের সাধারণ মানুষ তো পরের কথা এই দেশের অধিকাংশ মানুষই হয়তো জানেন না এই যে বিচারক যারা বিচার করেন তাদের বেশিরভাগের বসার জন্য আলাদা কক্ষ নেই। তারা রুম শেয়ার করেন এমনকি এজলাসও। আর সেরেস্তাদার, অফিস সহকারী থেকে শুরু করে জনবলের তীব্র সংকট তো আছেই। এমনকি রায় ও আদেশ লেখার জন্য কাগজ-ফরমের অভাব এবং অন্যান্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাও নেই। মামলার রায় লিখবেন সেই স্টেনো বা কম্পিউটার সব আদালতে আছে কী না সন্দেহ!
অবাক হবেন শুনে যে এদেশে সরকারি অনেক দপ্তরের জুনিয়র কর্মকর্তাদের জন্য নিয়মিত নিত্য নতুন গাড়ি কেনার জন্য রাষ্ট্রের বাজেট বরাদ্দের অভাব না হলেও বিচারকদের জন্য গাড়ি মেলে না। ফলে দেশের প্রায় সব জেলায় অতিরিক্ত জজ থেকে শুরু করে যুগ্ম জজ এবং বাকিদের মাইক্রোবাস শেয়ার করে কিংবা নিজের আয়োজনে আদালতে যেতে হয়। ওই যে বাজেট নেই। এই দেশের লাখ কোটি টাকা বাজেট হলেও বিচার বিভাগের মোট বাজেট বরাদ্দ বিটিভির চেয়েও কম।
কথাগুলো বলছি কারণ একটা দেশের বিচার বিভাগ ঠিক থাকলে বহু সমস্যার সমাধান হয়ে যায় আর বিচার বিভাগ ঠিক না থাকলে আইনের শাসন বা সুশাসন কোনটাই আসে না। এই তো কয়েকদিন আগে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিচার বিভাগ ব্যর্থ হলে কোনো সংস্কারই টিকবে না।
আমার বেশ মনে আছে, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরী অবস্থা জারি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পরদিন প্রথম আলোর প্রথম পাতায় আমার যে নিউজটা ছিলো সেটি হলো বিচার বিভাগের পৃথককরণ জরুরী। ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর ওই সময়ের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন যেটি ছিলো ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এরপর গত ১৮ বছরে বিচার বিভাগের অনেক অগ্রগতি হয়েছে কিন্তু ১৮ বছর পরে এসেও বিচার বিভাগে অবকাঠামোগত নানা সংকট প্রকট আকারে বিদ্যমান।
আইয়ুব খান থেকে শুরু করে এই দেশে সব আমলে সব সরকার শুধু উন্নয়নের গল্প বলে কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন! ২০০৭ সালে পৃথক বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হলেও দেশের এক তৃতীয়াংশ জেলায় এখনো চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবন নির্মাণ হয়নি। ডিসি অফিসের নীচ তলায় ৩-৪ টা রুম নিয়ে আবার কোথাও কোথাও টিনশেড অস্থায়ী ঘর বানিয়ে সেগুলোর কার্যক্রম চলে। খুলনায় কিংবা অনেক জেলায় পুরোনো আদালত ভবন থেকে মাঝে মধ্যেই ইট কনক্রিট ভেঙে পড়ে। বর্ষাকালে পানি পড়ে। এগুলো লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে।
আমি প্রায়ই একটা কথা লিখি, বলি! একটা দেশের বিচার বিভাগ ঠিক না থাকলে বাকি সব আলাপ অর্থহীন। দেখেন পুলিশ, প্রশাসন থেকে শুরু করে একটা দেশের প্রায় সবকিছু ধ্বংসের পরেও শুধু যদি বিচার বিভাগটা ঠিক থাকে সেই দেশ আসলে ধ্বংস হবে না। আর বিচার বিভাগ যদি মাথা উঁচু করে তার কাজটা করতে না পারে, আইনের শাসন টিকে না থাকে তাহলে ওই দেশের ভবিষ্যত অন্ধকার!
আফসোস বাংলাদেশে আইনের শাসন আমরা গত ৫৪ বছরেও প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। সেই পথে শুধু যে অবকাঠামোগত সংকটই বড় বাঁধা তাই নয় রাষ্ট্রও নিজেও একটা বড় বাঁধা। কারণ যখন যারা ক্ষমতায় চায় তারা সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। আশা করছি এইসব সংকট পেরিয়ে এই দেশের বিচার বিভাগ এগিয়ে যাবে এবং একদিন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের নীতি নৈতিকতা আর বিবেকবোধ দিক বিশেষ করে বিচারকদের!
লেখক: শরিফুল হাসান: কলামিস্ট এবং সহকারী পরিচালক, ব্রাক।

