২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ একটি রায় ঘোষণা করল যা ভবিষ্যতের আইনজীবী ও সাধারণ মানুষদের মনে দীর্ঘদিন ধরে আলোড়ন সৃষ্টি করবে। বেগম খালেদা জিয়া ও অন্যান্য বনাম দুর্নীতি দমন কমিশন মামলাটি ছিল শুধুই একটি সাধারণ ফৌজদারি আপিল নয়। এটি ছিল বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের অনিয়ম ও রাজনৈতিক চাপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আইনশৃঙ্খলার মর্যাদা রক্ষা করার এক সাহসী পদক্ষেপ।
সর্বোচ্চ আদালত কেবলমাত্র অভিযোগ খারিজ করেনি। রায়ে মামলাটিকে “আইনের প্রকাশ্যভাবে বিকৃত প্রয়োগের উদাহরণ” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়, যা দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এক ধরনের বজ্রপাতের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় বিচার ব্যবস্থাকে রাজনীতির বাতাসে দোলায়মান বলে অভিযোগ করা হয়, সেই প্রেক্ষাপটে এই রায় ছিল ন্যায়পরায়ণতার এক দৃঢ় প্রতীক। এটি একটি মজবুত বাতিঘরের মতো, যা রাষ্ট্রের অতিপ্রভুত্বের অন্ধকার ঢেউয়ের বিরুদ্ধে সাহসের আলো ছড়াচ্ছে।
মামলা ও প্রেক্ষাপট:
জিয়া অনাথ আশ্রয় ট্রাস্ট মামলা শুধু একটি ফৌজদারি অভিযোগ ছিল না; এটি রাজনৈতিক ও আইনগতভাবে এক ধরনের নজরকাড়া ঘটনা। মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছিল যে বেগম খালেদা জিয়া, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে (১৯৯১-১৯৯৬), “প্রধানমন্ত্রীর অনাথ তহবিল” থেকে তহবিল অনিয়মভাবে নিয়ে তার স্বামীর নামে স্থাপিত ব্যক্তিগত ট্রাস্টে স্থানান্তর করেছিলেন। পরে এই তহবিল বেআইনিভাবে ব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে সহ-অ্যাপিলেন্টদের সাথে জড়িয়ে ধোয়া হয়েছিল। মামলাটি বিশেষ জজ আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর হাই কোর্ট বিভাগ দণ্ডের মাত্রা বাড়ায়।
সুপ্রিম কোর্টের রায় কেবল ফলাফলের কারণে নয়, বরং এর গভীর আইনগত বিশ্লেষণের কারণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আদালত কেবল প্রমাণ মূল্যায়নই করেনি, বরং মামলা পরিচালনার মূল ভিত্তিগুলোই খতিয়ে দেখেছে এবং তা “দুর্নীতিপূর্ণ ও কল্পিত প্রচেষ্টা” হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই বিশ্লেষণ রায়ের মূল আইনগত ভিত্তিগুলো উদঘাটন করে, যা বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থার জন্য এবং অনুরূপ সমস্যায় জড়িত সাধারণ আইনি ক্ষেত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করে।
অপরাধ ও দোষের মানসিকতা প্রমাণে ব্যর্থ রাষ্ট্রপক্ষ:
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মূল ভিত্তি হলো রাষ্ট্রপক্ষের মামলাটিকে পুরোপুরি খণ্ডন করা। আদালত দেখিয়েছে যে অপরাধমূলক কাজ এবং অপরাধমূলক মানসিকতা প্রমাণ করা যায়নি, যা কোনো ফৌজদারি দণ্ডের জন্য মৌলিক শর্ত। অপরাধমূলক কাজ এর ক্ষেত্রে আদালত একটি বড় ত্রুটি চিহ্নিত করেছে। দেখা গেছে, বেগম খালেদা জিয়াকে কখনো “প্রধানমন্ত্রীর অনাথ তহবিল” পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি এবং তিনি তাতে কোনো নিয়ন্ত্রণও করেননি। একটি মাত্র নথি—অ্যাকাউন্ট খোলার ফর্ম, চেক বা লেনদেনের রেকর্ড—ও তার স্বাক্ষর বহন করে না। রাষ্ট্রপক্ষের তত্ত্ব পুরোপুরি অনুমানের ওপর নির্ভর করেছিল, কোনো দৃঢ় প্রমাণের ওপর নয়।
এছাড়া, দোষের মানসিকতা প্রমাণেও রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। আদালত দেখিয়েছে যে তহবিলের সব লেনদেন জিয়া অনাথ ট্রাস্ট ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পুরোপুরি ট্রেস করা যায়। কোনো প্রমাণ নেই যে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে তহবিলের সুবিধা নিয়েছে। ট্রাস্টের পক্ষ থেকে বগুড়ায় জমি কেনা বরং দেখায় যে তহবিল বৈধ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। আদালত স্পষ্ট করেছে, কেবল তহবিল ব্যবহার না হওয়া বা এক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা কোনো “অবৈধ দখল” নয়। এমন অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য প্রয়োজন যে তহবিলটি বেআইনিভাবে ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
দুর্নীতিপূর্ণ মামলা পরিচালনার বিরুদ্ধে বিচার বিভাগের নিন্দা:
রায়ের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং নজিরবিহীন দিক হলো দুর্নীতিপূর্ণ মামলা পরিচালনার প্রমাণ। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে এই মামলা একটি মনগড়া ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত প্রচেষ্টা ছিল। এটি শীর্ষ আদালতের জন্য বিরল এবং শক্তিশালী পদক্ষেপ।
আদালত দেখিয়েছে, যে মামলার সব মূল উপাদান পূর্ণভাবে পূরণ হয়েছে। মামলা শুরু হয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন এবং তাদের তদন্ত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে। যুক্তিসঙ্গত কারণের সম্পূর্ণ অভাব ছিল। বিশেষ করে দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা হারুনুর রশীদ-এর “পরিকল্পিত কাজ” আদালতকে শক দিয়েছে। পুনঃনিযুক্ত হওয়ার পর তিনি পূর্বের রিপোর্টটি কপি করেছিলেন, যা বেগম জিয়াকে মুক্তি দিচ্ছিল। এরপর তিনি অতিরিক্ত একটি প্যারাগ্রাফ যুক্ত করে তাকে অভিযুক্ত করেছেন এবং মামলাটি দুর্নীতি দমন কমিশন এর অধীনে নিয়ে আসার জন্য চার্জ বাড়িয়েছিলেন। আদালত এটিকে পরিকল্পিত এবং দূষিত প্রক্রিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
দুর্নীতির উদ্দেশ্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আদালত দেখিয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, মামলা সময়সূচি (যখন বেগম জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন না), এবং তদন্ত কর্মকর্তার প্রাথমিক যাচাই যেমন কুয়েতি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ না করার ব্যর্থতা সব এই বিষয় প্রমাণ করে মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে। শেষে, অভিযুক্তদের রায় নিশ্চিত করেছে যে মামলা পুরোপুরি আসামিপক্ষের পক্ষেই সমাপ্ত হয়েছে। আদালত কমনওয়েলথ ও ভারতের দুর্নীতিপূর্ণ মামলা সংক্রান্ত রায়ের ভিত্তিতে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে: আইনকে রাজনৈতিক নির্যাতনের হাতিয়ার বানানো যাবে না, এবং সংবিধানের ধারা ৩১ আইনের সুরক্ষাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রটেকশন হিসেবে দাঁড় করায়।
একটি রায় যা রাষ্ট্রের ক্ষমতা পুনঃসীমাবদ্ধ করে:
জিয়া অনাথ ট্রাস্ট রায় শুধুমাত্র একটি সাধারণ খালাস নয়। এটি হলো বিচার বিভাগের নৈতিক সিদ্ধান্ত, যা রাষ্ট্রের ক্ষমতা এবং নাগরিকের অধিকার মধ্যে ভারসাম্য পুনঃস্থাপন করেছে। রায়ের প্রভাব কেবল এক মামলার সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ভবিষ্যতকেও প্রভাবিত করবে।
প্রথমত, রায় স্পষ্ট করে দেয় যে আইনের শাসন সর্বোপরি, অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক না কেন, কোনো নাগরিক আইনের সুরক্ষার বাইরে নয়, এবং কোনো কর্তৃপক্ষ এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী—আইনের বাইরে নয়। দ্বিতীয়ত, এটি রাষ্ট্রপক্ষের বিচারের ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। আদালত জানিয়েছে যে তদন্তকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের কার্যক্রম হতে হবে নিরপেক্ষ, প্রমাণভিত্তিক এবং রাজনৈতিক চাপ বা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ থেকে মুক্ত।
তৃতীয়ত, এটি ভবিষ্যতের আসামিদের জন্য একটি আইনগত রোডম্যাপ স্থাপন করেছে। যারা মনগড়া মামলার শিকার হতে পারেন, তাদের জন্য এই রায় প্রতিরক্ষা আইনজীবীদের হাতে শক্তিশালী নীতিগত টুল সরবরাহ করে, যাতে দুর্বল বা উদ্দেশ্যমূলক মামলা উন্মোচিত করা যায়। চতুর্থত, এটি একটি শক্তিশালী সতর্কবার্তা দিচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী আদালতকে রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে রূপান্তরিত করার প্রবণতা প্রতিরোধ করে।
আপিল বিভাগের মন্তব্যে সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগের সাংবিধানিক উদ্দেশ্য স্মরণ করিয়েছে: “আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, আদালত শুধু একটি কোর্টরুম নয়। এটি একটি প্রক্রিয়া এবং একটি আত্মা, যা সংবিধানগত অধিকার লঙ্ঘন এবং আইনের প্রক্রিয়া হরণ থেকে রক্ষা করার জন্য গঠিত ও লালিত।”
একই সঙ্গে আদালত সতর্ক করেছে যে আইন প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক নাটক বানানো যাবে না:“আদালত নিশ্চিত করবে যে বিচারিক প্রক্রিয়াকে কোনো ত্যাগী রীতিতে হ্রাস করা হবে না।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে আদালত বিচার বিভাগের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত মামলার নাটকীয়তা থেকে বিচারিক স্থানকে মুক্ত করেছে।
ন্যায় কখনো সাজানো হয় না, ন্যায়ই সত্য প্রকাশ করে:
রায়ের শেষাংশে সুপ্রিম কোর্ট জাতিকে স্মরণ করিয়েছে যে আইন কোনো পোশাক নয়, ন্যায় কোনো অভিনেতা নয়, আর কোর্টরুম কোনো মঞ্চ নয় যেখানে ক্ষমতার নাটক সাজানো হয়। যখন রাষ্ট্র মামলা-প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক নাটকে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে, বিচার বিভাগকে সতর্ক প্রহরীর মতো সেই নাটকের পর্দা নামাতে এবং অতিরিক্ত মনোযোগ বা প্রদর্শন বন্ধ করতে হয়। জিয়া অনাথ ট্রাস্ট মামলায় আদালত ঠিক তাই করেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, যা নিজেকে মুক্ত বলার সাহস রাখে:
- কোর্টরুম সত্যের আশ্রয়স্থল হয়ে থাকতে হবে,
- কখনো রাজনৈতিক শাস্তির থিয়েটার নয়,
- কখনো ত্যাগী আচার বা আনুষ্ঠানিকতার মঞ্চ নয়।
জিয়া অনাথ ট্রাস্ট রায় দেখিয়েছে, আদালত কখনো রাজনৈতিক নাটকের হাতিয়ার নয়। কোর্টরুম হলো সত্যের আশ্রয়স্থল, যেখানে ন্যায়ই সর্বদা জয়ী হয়।
লেখক: মোকররমুস শাকলান: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

