বাংলাদেশের বিচার বিভাগ দীর্ঘদিন ধরে যে কাঙ্ক্ষিত স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার অপেক্ষায় ছিল, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেই যাত্রা নতুন একটি অধ্যায়ে প্রবেশ করল। বহু আলোচিত এই সচিবালয়ের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হওয়া বিচার বিভাগে কাঠামোগত সংস্কারের বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অধ্যাদেশ জারির পরই সচিবালয় কার্যকর করার উদ্যোগ শুরু হয়। রেজিস্ট্রার জেনারেলকে সচিবের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া এবং দ্রুত প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার পদক্ষেপ বিচার বিভাগের একক পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এতদিন বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলাবিধান নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
নতুন অধ্যাদেশের ৭ ধারা কার্যকর হলে এসব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা থাকবে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সচিবালয়ের হাতে। এতে বিচার বিভাগের সাংবিধানিক অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আইনজীবী শিশির মনিরও এটিকে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে এক মাইলফলক আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, অধস্তন আদালত এখন নির্বাহী নিয়ন্ত্রণের বাইরে এসে উচ্চ আদালতের অধীন প্রকৃত তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে যাবে। ফলে বিচারকদের বদলি, শৃঙ্খলা বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে আর নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থাকবে না। রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় এটি একটি বড় ইতিবাচক পরিবর্তন।
অধ্যাদেশে আর্থিক স্বাধীনতাও নিশ্চিত করা হয়েছে। ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির হাতে আসায় উন্নয়ন প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি হবে। অতীতে প্রশাসনিক জটিলতায় যেসব প্রকল্প আটকে থাকত, তা এখন কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের রায় দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। কিন্তু সেই রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা ঘোষণা করা হলেও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের বড় অংশ রয়ে যায় আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে। বিচার বিভাগ ও নাগরিক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে এই দ্বৈত শাসন দূর করার দাবি জানিয়ে আসছিল। নতুন কাঠামো সেই দীর্ঘদিনের সাংবিধানিক ও নৈতিক দাবিকে বাস্তব রূপ দিচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু এখানেই দায়িত্ব শেষ নয়। সচিবালয়ের কাঠামো দাঁড় করানো, জনবল নিয়োগ, প্রশাসনিক পুনর্গঠন, এবং ৭ ধারা কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় গেজেট প্রকাশ—এসব কাজ দ্রুত ও নিষ্ঠার সঙ্গে শেষ করতে হবে। ভবিষ্যতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, বিচার বিভাগের এই অগ্রগতি যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কোনো সরকারের অনুগ্রহ নয়—এটি সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার এবং রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা বিচার ব্যবস্থাকে যেমন শক্ত ভিত দেবে, তেমনি নাগরিকের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারকেও করবে আরও দৃঢ়। এখন প্রয়োজন বিচারকদের পেশাগত শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, স্বচ্ছতা বাড়ানো এবং দ্রুত ও মানসম্মত বিচারসেবা পৌঁছে দেওয়া।
স্বতন্ত্র সচিবালয় সেই কাঠামো তৈরি করেছে। এখন এটিকে কার্যকর ও জনবান্ধব করতে দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা ও দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

