ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোতে বিচার বিভাগ নিজস্ব সচিবালয় পরিচালনা করে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগও সেই কাঠামোর দিকে এগোচ্ছে। এই পদক্ষেপ বিদেশী বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক বার্তা দেবে।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তি হলো আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ। প্রতিটি অঙ্গের কার্যপ্রণালী সংবিধানে নির্দিষ্ট। শাসনতন্ত্রের সীমারেখার মধ্যে এগুলো পরিচালিত হলে গণতান্ত্রিক দেশে সাধারণত কোনো সঙ্কট থাকে না। পশ্চিমা গণতন্ত্রের দেশ যেমন যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের উদাহরণ। সেখানে তিনটি বিভাগ নিয়মমাফিক কাজ করে। ফলে দেশগুলো শাসনতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়া টেকসই গণতন্ত্র গড়তে পেরেছে।
গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার আলোয় বাংলাদেশের জন্ম। স্বাধীনতার পর শাসনতন্ত্র প্রণীত হলেও ৫৪ বছরেও এখানে সংবিধান মেনে চলার যথাযথ নজির স্থাপন হয়নি। ক্ষমতায় আসা যিনি-ই হোক, তিনি সুবিধামতো সংবিধান লঙ্ঘন বা পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন। ফলে দেশের গণতন্ত্র এখনও নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিক চাওয়ার অন্যতম অংশ ছিল বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা। মানুষ যাতে নির্বাহী বিভাগের অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিকার পেতে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন, সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে দীর্ঘদিন ধরে বিচার বিভাগকে কার্যকর একক প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে আনার দাবি উঠেছে।
এ দাবি অবশেষে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। সরকার গত সোমবার ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ ২০২৫’ গেজেটে প্রকাশ করেছে। এটি কার্যকর হলে অধস্তন আদালত থেকে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত পুরো বিচার প্রশাসন সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে চলে যাবে। স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো বিচার বিভাগের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রায় পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগ থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে।
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ ২০২৫ শুধু নতুন একটি সচিবালয় প্রতিষ্ঠা নয়। এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে কাঠামোগতভাবে পুনর্গঠনের রূপরেখা। সংবিধানের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক রাখাকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করেছে। এছাড়া ১০৯ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টকে অধঃস্তন আদালতের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা প্রদান করে।
তবে বাস্তবে বিচারপ্রশাসন, নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলাবিধির অনেক দায়িত্ব বহু বছর ধরে নির্বাহী বিভাগ অর্থাৎ আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল। ২০০৭ সালে আপিল বিভাগের ৭৯/১৯৯৯ সিভিল রায়ে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের আংশিক অগ্রগতি হয়েছিল। তবে সুপ্রিম কোর্টের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠন, যা প্রশাসনিক স্বাধীনতার পূর্ণ রূপ দিতে অপরিহার্য, তখন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ২০২৫ সালের এ অধ্যাদেশ সেই দীর্ঘস্থায়ী সাংবিধানিক বৈসাদৃশ্য দূর করবে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী সচিবালয়ের ক্ষমতার মধ্যে থাকবে—অধস্তন আদালতের প্রতিষ্ঠা বা বিলোপ, এখতিয়ার নির্ধারণ, দেশের নিম্ন আদালতের গঠন ও কাঠামো, প্রয়োজনীয় পদসংখ্যা, নতুন আদালত স্থাপন কিংবা পুরনো আদালতের পুনর্গঠন। এছাড়া জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের নিয়োগ ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণও সচিবালয়ের মাধ্যমে হবে। দীর্ঘদিন বিচার বিভাগের দুর্বল জায়গা হিসেবে যেসব নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলাবিধি নির্বাহী-আবদ্ধভাবে পরিচালিত হতো, তা এখন সুপ্রিম কোর্টের অধীনে চলে যাবে। এতে রাজনৈতিক প্রভাব কমবে এবং জুডিশিয়াল সার্ভিসে লবিংনির্ভর অস্বচ্ছতা কমতে পারে।
ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোতে বিচার বিভাগ নিজস্ব সচিবালয় পরিচালনা করে। বাংলাদেশও সেই কাঠামোর দিকে যাচ্ছে, যা বিদেশী বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে ইতিবাচক বার্তা দেবে।
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ ২০২৫ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে অন্যতম বড় প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন। যদি এটি সময়মতো, স্বচ্ছভাবে এবং সুপ্রিম কোর্ট-সরকার সমন্বয়ে বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত, প্রশাসনিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিচার কাঠামো প্রদান করা সম্ভব হবে।

