অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো শ্রমিক। তাদের পরিশ্রমেই শিল্পের চাকা ঘোরে এবং গড়ে ওঠে উন্নয়নের স্থাপত্য। অথচ বাংলাদেশে শ্রম আদালতের প্রাঙ্গণে ন্যায়ের সন্ধান করতে গিয়ে তারা প্রতিনিয়ত এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হন। শ্রমিকের পক্ষে দাঁড়াতে সক্ষম আইনজীবীর স্বল্পতা এবং আইনি সহায়তায় শ্রেণীবৈষম্য ন্যায়বিচারের দ্বার রুদ্ধ করে তোলে। আদালত তাদের শেষ আশ্রয় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটাই আজ অনেক শ্রমিকের জন্য এক নিদারুণ প্রহসনের মঞ্চ।
মজুরি, ছুটি, অধিকার বা ন্যায্য পাওনার লড়াই যখন কাগজের পাতায় বন্দি হয়ে পড়ে, আর আইনজীবীর অভাবে বছরের পর বছর মামলা স্থগিত থাকে, তখন ন্যায় যেন ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করে তাদের হাতেই, যাদের রক্ত-ঘামে দেশের অর্থনীতি জীবন্ত। গরিব শ্রমিক যখন আদালতের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে খালি হাতে ফিরে যায়, সেই শূন্যতা কেবল তার ঘরের চুলোর আগুনকেই নিভিয়ে দেয় না—এটি পুরো আইনি ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমিয়ে আনে। সমাজের মর্মমূলে ধরে এক বিষাক্ত ক্ষত। শ্রমিকের নীরব কান্না”আজ আর ব্যক্তিগত বেদনার গল্প নয়; এটি এক জাতীয় সংকট, এক সমষ্টিগত ক্ষত, যা আমাদের সমাজের গভীরে ধীরে ধীরে বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ করুণ গাথা বুঝতে হলে শুধু চোখ খুললেই চলবে না—হৃদয়ের কানকেও সাজাতে হবে, সহমর্মিতার প্রতিটি সুরে।
শ্রম আদালতে শ্রমিকরা কেন পর্যাপ্ত আইনি সহায়তা পান না এবং কেন এ বৈষম্য প্রকট, এর পেছনে গভীর অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক কারণ রয়েছে। এ কারণগুলো যেন এক অদৃশ্য প্রাচীর, যা শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার থেকে তাদের দূরে সরিয়ে রাখে। এর প্রধান কারণ হলো শ্রমিক আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবীর স্বল্পতা। শ্রম আইন একটি বিশেষায়িত শাখা হওয়ায় অধিকাংশ আইনজীবী এতে আগ্রহী হন না। শ্রমিকের পক্ষে মামলা লড়লে পারিশ্রমিক কম বা অনিয়মিত হওয়ায় আইনজীবীদের আর্থিক অনীহা থাকে।
আইন ও বিচার বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ শ্রমিকের জন্য একজন শ্রম আইনজীবীও নেই। এ সংখ্যাই বলে দেয়, বিচারের প্রত্যাশা কতটা ক্ষীণ। বড় প্রতিষ্ঠান বা মালিকপক্ষের আইনজীবীর ফি অনেক বেশি হওয়ায় তারা অধিক পারিশ্রমিকের দিকে ঝোঁকেন। জাতীয় আইনি সহায়তা সংস্থার তথ্য অনুসারে, শ্রমিকের মামলা নিষ্পত্তির হার অন্যান্য দেওয়ানি মামলার চেয়ে ২০ শতাংশ কম। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, শ্রম আদালতে নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন এমন আইনজীবীর সংখ্যা দেশের মোট নিবন্ধিত আইনজীবীর মাত্র ৫ শতাংশ।
অন্যদিকে প্রশাসনিক ও প্রক্রিয়াগত দুর্বলতা এ বৈষম্যকে আরো তীব্র করেছে। শ্রম আদালতের বিচারকদের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বলা বাহুল্য, এ কারণে শ্রম আদালতের মামলা নিষ্পত্তির হার অন্যান্য আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হারের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ কম। মামলা দাখিল এবং শুনানির প্রক্রিয়ায় প্রশাসনিক জটিলতা এত বেশি যে একজন স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিক তা বুঝতে পারেন না। মাত্র ১২ শতাংশ শ্রমিক তাদের অধিকার সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে সচেতন বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক শ্রমশক্তি জরিপে উঠে এসেছে। এ অজ্ঞতার সুযোগ নেয় মালিক পক্ষ। মালিক পক্ষের নিপীড়নের শিকার হন শ্রমিকরা। অনেক সময় সামাজিক বাধা ও চাকরি হারানোর ভয়ে ভুক্তভোগী শ্রমিকরা অভিযোগও দায়ের করেন না। এর পরও শ্রম আদালতে জমে থাকা মামলার সংখ্যা বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে বলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
শ্রমিকদের সামাজিক বৈষম্য এবং সচেতনতার অভাবও এর অন্যতম কারণ। বিচার চাইতে গেলে চাকরি হারানোর ভয় শ্রমিকদের মুখ বন্ধ করে দেয়। শ্রম অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিক অসন্তোষের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ৪০ শতাংশ হলো মজুরি ও ন্যায্য পাওনা নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ, যার নিষ্পত্তি হয় না আদালতে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, দীর্ঘসূত্রতার কারণে শ্রমিক মামলার নিষ্পত্তিতে গড়ে দুই-তিন বছর সময় লাগে। এসব কারণে উৎপাদনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
শ্রম আদালতে বিচার পাওয়ার বৈষম্য কেবল ব্যক্তিগত বঞ্চনা নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং মানবাধিকারের প্রশ্নে বড় ধরনের হুমকি। অর্থনৈতিক মডেলের পূর্বাভাস অনুযায়ী, যদি এ বৈষম্য অব্যাহত থাকে, তবে ২০৪০ সাল নাগাদ শ্রম আদালতের মামলা নিষ্পত্তির হার মাত্র ১ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা কার্যত বিচার প্রক্রিয়ার পতন নির্দেশ করে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক মডেলের পূর্বাভাস বলছে, বিচার না পাওয়ায় শ্রমিক অসন্তোষ এবং বিবাদের হার ২০৪০ সাল নাগাদ ২৫ শতাংশে পৌঁছতে পারে, যা শিল্প ক্ষেত্রে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, শ্রমিকের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত না হলে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ঝুঁকিতে পড়ে।
ভবিষ্যতে এর ফল হবে আরো করুণ—শিল্পক্ষেত্রে অস্থিরতা বাড়লে জাতীয় উৎপাদন ও রফতানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মানবাধিকারের লঙ্ঘন আরো প্রকট হবে। সামাজিক ন্যায়বিচারের পতন ঘটবে। বিশ্বব্যাংকের শ্রমবাজার বিশ্লেষণ অনুসারে, শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে উৎপাদনশীলতা গড়ে ৩০ শতাংশ কমে যায়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি গবেষণা দেখায়, শ্রমিকদের আইনি সহায়তা বাড়ানো হলে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং উৎপাদনশীলতা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।
বিদ্যমান এসব বৈষম্য বন্ধ করতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি অস্থিতিশীল শিল্প এবং মানবিকতাহীন বিচার ব্যবস্থার শিকার হবে। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ছাড়া কোনো জাতির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি টেকসই হতে পারে না। এ করুণ গাথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যে জাতির শ্রমিক কাঁদে, সে জাতি কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।
ড. তারনিমা ওয়ারদা আন্দালিব: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক।
দাউদ ইব্রাহিম হাসান: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী গবেষক। সূত্র: বণিক বার্তা

