অনেকের কাছে একটি ফ্ল্যাট বা প্লট কেনা ছিল নিরাপদ ভবিষ্যতের স্বপ্ন। কিন্তু হাজার হাজার বাংলাদেশির জন্য সেই স্বপ্ন এখন আদালতের বারান্দায় ঘুরে বেড়ানোর দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে লেগে যাচ্ছে এক দশকেরও বেশি সময়। ফলে সময়মতো আইনি প্রতিকার পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
ফ্ল্যাট হস্তান্তরে বিলম্ব, রেজিস্ট্রেশন না দেওয়া, হস্তান্তরের পর ত্রুটি ধরা পড়া এবং চুক্তির বাইরে অতিরিক্ত টাকা দাবির মতো অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। এসব বিষয়ে ক্রেতারা সরাসরি ডেভেলপার কোম্পানির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে পারছেন না। আইন অনুযায়ী, তাদের প্রথমে যেতে হয় সালিসী ট্রাইব্যুনালে। সালিসী ট্রাইব্যুনাল দ্রুত ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যে চালু হলেও বাস্তবে এটি দীর্ঘসূত্রতা, বাড়তি ব্যয় ও হতাশার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশের আদালতগুলোতে অ্যাপার্টমেন্ট ও প্লট সংক্রান্ত ২৪,৪০৩টি সালিসী আবেদন বিচারাধীন রয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত আর্থিক দাবির পরিমাণ প্রায় ১৯,৬৩০ কোটি টাকা।
শুধু ঢাকায় বিচারাধীন ১৭,৩০৮টি মামলা রয়েছে, যার সঙ্গে জড়িত প্রায় ১৪,৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০ বছরের বেশি পুরোনো ২,১৪৪টি মামলা রয়েছে, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ২,৩০০ কোটি টাকা। পাঁচ বছরের বেশি পুরোনো ২,৪০২টি মামলা রয়েছে, যার সঙ্গে জড়িত প্রায় ২,০৮০ কোটি টাকা।
রাজধানীর বাইরে বিচারাধীন ৭,০৯৫টি সালিসী আবেদন রয়েছে, যার সঙ্গে জড়িত প্রায় ৫,১৩০ কোটি টাকা। ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি মামলা রয়েছে চট্টগ্রামে—৩,২৪৪টি, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৩,২০০ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে সিলেট, যেখানে ১,০৮৯টি মামলায় জড়িত প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।
ডেভেলপাররা দায়মুক্তির সুযোগ পাচ্ছে:
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম জানান, ২০১০ সালের আগে অ্যাপার্টমেন্ট বা প্লট কেনার সমস্যা হলে ক্রেতারা সরাসরি দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা করতে পারতেন। কিন্তু আবাসন ব্যবসায়ীদের প্রভাবশালী সংগঠন রিহ্যাব সরকারের ওপর চাপ দিয়ে রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন প্রণয়ন করিয়েছে।
ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম সালিশি ব্যবস্থাকে মৌলিকভাবে দুর্বল আখ্যা দেন। তিনি বলেন, “এখানে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা যায় না, ক্ষতিপূরণের কার্যকর বিধান নেই, এবং ট্রাইব্যুনালের রায় বা অ্যাওয়ার্ড বাস্তবে অনেক সময় কার্যকর করা যায় না। ফলে আবাসন ব্যবসায়ীরা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে অনেক ডেভেলপার রেজিস্ট্রেশন না দিয়ে, বিক্রির পরও ফ্ল্যাট ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে ক্রেতার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করছে। এই রুল নিষ্পত্তি হলে লাখ লাখ ক্রেতা উপকৃত হবেন।”
১৩ বছরেও ফ্ল্যাট বুঝে পাননি ক্রেতা:
রাজধানীতে ফ্ল্যাট কিনে প্রতিকার না পাওয়ার এক জটিল উদাহরণ হলো মোটরগাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানিকারক জালাল আহমেদ। ২০১২ সালের শুরুতে তিনি রাজধানীর কালাচাঁদপুরে ‘গোল্ডেন রেসিডেন্ট ডেভেলপার’ কোম্পানির আবাসন প্রকল্পে ১,২০০ বর্গফুটের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ৭৬ লাখ টাকায় কিনেছিলেন। ওই বছরের জুলাই মাসে তিনি পুরো টাকা পরিশোধ করলেও, চুক্তি অনুযায়ী সেপ্টেম্বর মাসে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হয়নি।
নির্মাণকাজ দেরি হওয়ায় তিনি ২০১৫ সালের জুনে ঢাকার মহানগর জেলা জজ আদালত (সালিসী ট্রাইব্যুনাল)-এ প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেন। তারপরও ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি এখনও ফ্ল্যাটের দখল বুঝে পাননি। তার আইনজীবী ফেরদৌস আহমেদ পলাশ বলেন, “ফ্ল্যাট বা প্লট কেনার পর কোনো সমস্যায় পড়লে ক্রেতা সরাসরি মামলা করতে পারেন না। ২০১০ সালের আইন অনুযায়ী, জেলা জজ আদালতের মাধ্যমে সালিসী ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হয়।”
জালালের মামলাতেও আদালত একটি তিন সদস্যের সালিসী বোর্ড গঠন করে। চেয়ারম্যান ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ। প্রায় দেড় বছর ধরে শুনানি শেষে বোর্ড দ্রুত অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তরের সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু পরে ডেভেলপার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ট্রাইব্যুনালের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আপত্তি দাখিল করেন। প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেলেও শুনানি চলতে থাকে এবং নিষ্পত্তি হয়নি।
জালাল আহমেদ বলেন, “প্রায় ১৩ বছর হলো, অ্যাপার্টমেন্ট বুঝে পাওয়া তো দূরের কথা, আমাকে উল্টো দুটি ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় ফেলা হয়েছে। সালিসী মামলাও শেষ হয়নি, অথচ ফ্ল্যাটের নির্মাণ ২০১৫ সালে শেষ হয়েছে।” তিনি জানান, গত এক দশকে তাকে ৬০ বারের বেশি আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে। আইনজীবীর ফি ও আদালতের খরচ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৮ লাখ টাকার বেশি। ডেভেলপার কোম্পানি এখন ওই ফ্ল্যাট অন্য একজনকে ভাড়া দিয়েছে। জালাল আরও বলেন, “সর্বশেষ ১৩ নভেম্বর শুনানি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ডেভেলপার প্রভাবশালী আইনজীবী নিয়োগ করে শুনানি আবার ছয় মাস পিছিয়ে দিয়েছে।”
এরপরও ‘গোল্ডেন রেসিডেন্ট ডেভেলপার’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সলিম উল্লাহ বলেন, “সমস্যা হয়েছে, ক্রেতা আদালতের আশ্রয় নিয়েছে। আদালতের ওপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। আদালত যে রায় দেবেন, আমি তা মেনে নেব।”
আট বছরে প্রতিকার, ব্যতিক্রমী ঘটনা:
কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘ বিলম্বের পরও ক্রেতারা ফ্ল্যাটের দখল পেয়েছেন। তবে এমন ঘটনা খুবই বিরল। আজিমপুরের বাসিন্দা আশিক আল জলিল ২০১০ সালের জুলাইয়ে একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। চুক্তি অনুযায়ী ফ্ল্যাটের দখল পাওয়ার কথা থাকলেও তিনি তা পাননি। একই বছর তিনি সালিসী আইনে মামলা করেন।
প্রায় আট বছর পরে তিনি মামলায় জয়লাভ করেন। তিন বছর ছয় মাস পরে সালিসী বোর্ড তার পক্ষে প্রতিবেদন দেয়। এরপর শুনানি শেষ হতে আরও প্রায় চার বছর লাগে। অবশেষে ২০১৮ সালের নভেম্বরে তিনি ১,০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন দলিল ও দখল পান। ট্রাইব্যুনাল তাকে ৬ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দিলেও দ্রুত ফ্ল্যাট পেতে তিনি সেই অর্থ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেন।
বিচারকদের ওপর চাপ ও সময়সীমার অভাব:
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল সমস্যা সালিসী ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যেই নিহিত। আইন অনুযায়ী জেলা বা মহানগর জজরা সালিসী কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করেন। শুনানির জন্য সাধারণত অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বোর্ড গঠন করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আফতাবুল ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, “ওই বোর্ডের কোনো স্পষ্ট জবাবদিহিতা আইনে নেই। ফলে বোর্ড কখন শুনানি করবেন বা প্রতিবেদন দেবেন, তার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই।”
তিনি আরও বলেন, “রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন পরিবর্তন করে সরাসরি মামলা করার বিধান রেখে নির্দিষ্ট সময়ে মামলা নিষ্পত্তির নিয়ম করা উচিত। নাহলে জেলা জজদের ওপর চাপ কমাতে অতিরিক্ত জেলা বা কম পদমর্যাদার বিচারককে সালিসী মামলার বিচার করার অধিকার দিয়ে আইন সংশোধন করা যেতে পারে।”
আইনজীবী আফতাবুল ইসলাম সিদ্দিকী মনে করেন, “একজন জেলা জজকে জেলার সবচেয়ে বেশি মামলার চাপ সামলাতে হয়। সেখানে হাজার হাজার ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা চলমান। তাই সালিসী মামলার নিষ্পত্তি স্বাভাবিকভাবেই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।”
আইনের বৈধতা প্রশ্নে হাইকোর্টের রুল ও সংস্কারের দাবি:
শুধুমাত্র সালিসী আইনে ফ্ল্যাট ও প্লট ক্রেতাদের প্রতিকার চাওয়ার বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৯ সালের ৭ মে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। তবে এই রুলের ওপর এখনও শুনানি হয়নি। রিহ্যাব সভাপতি ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, “আইনটি সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনের মাধ্যমে ক্রেতা ও বিক্রেতা—উভয়ই প্রতিকার পায়।”
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “আইন আদালতের মাধ্যমে প্রয়োগ হয়। তবে মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হলে সমাধানের জন্য আইন মন্ত্রণালয় বা সুপ্রিম কোর্টকে পদক্ষেপ নিতে হবে।”
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম সতর্ক করে বলেন, “এই আইন সংশোধন করা জরুরি। বিশেষ আদালত গঠন করে দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত না করলে এই সংকট আরও গভীর হবে। নাহলে ফ্ল্যাট ক্রেতাদের জন্য ব্যবস্থা ব্যর্থই থেকে যাবে।”

