বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া প্রকাশের পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন। আইনটি কি সত্যিই মানুষের অধিকার সুরক্ষায় সহায়ক হবে, নাকি পুরোনো অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটবে নতুন ভাষায়—এই প্রশ্নই এখন কেন্দ্রে।
খসড়াটি প্রথম দেখায় কিছুটা আশাব্যঞ্জক। বিশেষ করে যেকোনো পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট বা টেলিযোগাযোগ সেবা বন্ধের সুযোগ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে ধরা যায়। গত এক দশকে দেশে ইন্টারনেট শাটডাউন প্রায় নিয়মিত প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে পরিণত হয়েছিল। নির্বাচন, আন্দোলন বা সংকটকাল এলেই বন্ধ হয়ে যেত যোগাযোগ ব্যবস্থা। এতে নাগরিক জীবন যেমন ব্যাহত হয়েছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্থনীতি। এই বাস্তবতায় খসড়ার এ অবস্থান নাগরিক স্বাধীনতা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য স্বস্তির বার্তা দেয়।
অননুমোদিত নজরদারি নিষিদ্ধ করার ঘোষণাও নীতিগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা আধুনিক রাষ্ট্রে কোনো বাড়তি সুবিধা নয়; এটি সাংবিধানিক অধিকার। আইন প্রণেতারা যদি এই নীতিতে অটল থাকেন, তবে বাংলাদেশ একটি অধিকতর অধিকারভিত্তিক ডিজিটাল রাষ্ট্রের পথে এগোতে পারে। তবে ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি গুরুতর উদ্বেগও রয়েছে।
খসড়ার সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক অংশ হলো ‘বিদ্বেষমূলক’, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নকারী’ কিংবা ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী’ যোগাযোগ সংক্রান্ত ধারা। এসব শব্দের আইনগত সংজ্ঞা স্পষ্ট নয়। অতীতে এমন অস্পষ্ট শব্দচয়ন কীভাবে প্রয়োগ হয়েছে, তার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের নতুন নয়। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অধীনে সমালোচনা, ব্যঙ্গ বা ভিন্নমত অনেক সময়ই রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
এই খসড়ায় শাস্তির মাত্রা সেই আশঙ্কা আরও বাড়িয়েছে। পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা বড় অঙ্কের জরিমানার বিধান একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়। রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে ‘ভুল কথা’ বলার মূল্য অনেক বেশি। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতায়। মানুষ আইনের প্রয়োগের আগেই নিজেকে সংযত করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তৈরি হয় আত্মনিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি। তখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কাগজে থাকলেও বাস্তবে সংকুচিত হয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিচারিক তদারকি। খসড়ায় স্পষ্ট করে বলা হয়নি, কোনো নজরদারি, তথ্য সংগ্রহ বা কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আগে আদালতের অনুমোদন বাধ্যতামূলক কি না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর কার্যকর ও স্বাধীন নজরদারি না থাকলে ভালো আইনও দ্রুত অপব্যবহারের হাতিয়ারে পরিণত হতে পারে। বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতা সেটিই দেখিয়েছে।
এখানে মূল সমস্যা শুধু আইনের ভাষায় সীমাবদ্ধ নয়। প্রশ্নটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতির সঙ্গেও জড়িত। শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো ও জবাবদিহির পরিবেশে এই খসড়া হয়তো নাগরিক অধিকার রক্ষার কার্যকর মাধ্যম হতে পারত। কিন্তু যেখানে জবাবদিহি দুর্বল, সেখানে অস্পষ্ট আইন প্রায়ই ভিন্নমত দমনের সহজ পথ হয়ে ওঠে।
এই অধ্যাদেশকে জনগণের জন্য ইতিবাচক করতে হলে কয়েকটি মৌলিক সংশোধন জরুরি। অস্পষ্ট শব্দ বাদ দিয়ে নির্দিষ্ট ও সীমিত সংজ্ঞা দিতে হবে। সব ধরনের নজরদারি ও কঠোর ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বিচারিক অনুমোদন নিশ্চিত করতে হবে। শাস্তির মাত্রা হতে হবে পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং শেষ অবলম্বন হিসেবে প্রয়োগযোগ্য।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটি একটাই। আমরা কি এমন একটি আইন চাই, যা নাগরিককে শক্তিশালী করে, নাকি এমন একটি আইন, যা নাগরিককে নীরব থাকতে শেখায়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সদিচ্ছার ওপর।
লেখক : শামস নজীব অর্ক; জ্যেষ্ঠ আইন কর্মকর্তা (ইনচার্জ); দৈনিক প্রথম আলো।

