দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের কারণে দীর্ঘদিন ধরে সংকটে থাকা বীমা প্রতিষ্ঠান ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স অবশেষে ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটছে। গাড়ি বিক্রি, কর্মী ছাঁটাই এবং অফিস একত্রীকরণের মতো নানা পদক্ষেপ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কিছুটা ব্যয় হ্রাস করলেও গ্রাহকদের বিপুল পরিমাণ বকেয়া দাবির মুখে এটি এখনও বড় ধরনের আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)*র তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কাছে গ্রাহকের পাওনা রয়েছে ২ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা। অথচ এ পর্যন্ত পরিশোধ করা হয়েছে মাত্র ১৯৪ কোটি টাকা যা বিমা দাবির মাত্র ৬ শতাংশ।
বর্তমানে কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এই বিপুল সম্পদ থাকার পরও গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে কোম্পানিটি। আইডিআরএর মিডিয়া ও যোগাযোগ পরামর্শক সাইফুন্নাহার সুমি এক সাক্ষাৎকারে জানান, সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির কাছে নির্দিষ্ট পরিশোধ পরিকল্পনা চাওয়া হলেও তা উপস্থাপন করা হয়নি। ফলে কর্তৃপক্ষ তাদেরকে সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকের দাবি মেটানোর নির্দেশ দিয়েছে। তিনি বলেন, নির্দেশনা না মানলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। একইসঙ্গে ব্যবসা সম্প্রসারণের দিকেও গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
কোম্পানির এক অভ্যন্তরীণ নথিতে দেখা গেছে, গাড়ি বিক্রি, দুর্বল অফিসগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী অফিসগুলোর একত্রীকরণ এবং নিয়ম মেনে কমিশন প্রদানসহ নানা পদক্ষেপে কোম্পানিটি ৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয় হ্রাস করেছে। এছাড়া কয়েকটি অফিস ভাড়া দিয়ে আয় বেড়েছে ১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফের সচিব মো. কলিম উদ্দিন বলেন, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিশাল পরিমাণ বকেয়া বিমা দাবি পরিশোধ করা যা প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান আয়ে সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরও জানান, কোম্পানির সুনাম নষ্ট হওয়ায় নতুন পলিসি বিক্রি কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য সম্পদ বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তবে সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণেও জটিলতা দেখা দিচ্ছে। তার ভাষায়, “অনেক সম্পদের মূল্য কাগজে-কলমে কারসাজির মাধ্যমে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল এখন প্রকৃত মূল্য অনুযায়ী ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না।”
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকায় সম্ভাব্য ক্রেতারাও এগিয়ে আসছে না যা সম্পদ বিক্রির প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে।
আইডিআরএর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে কোম্পানিটির ১ লাখ ৭২ হাজার সক্রিয় পলিসি রয়েছে তবে গত বছর ১১ হাজার ১৩৫টি পলিসি বাতিল করেছেন গ্রাহকরা।
এই পরিস্থিতির পেছনে যে জটিল দুর্নীতি জড়িত তার প্রমাণ মেলে আইডিআরএ কর্তৃক পরিচালিত এক বিশেষ অডিট প্রতিবেদনে। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে শিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোম্পানি নামক একটি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্মকে দিয়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের আর্থিক কার্যক্রমের ওপর অডিট চালানো হয়। ২০২২ সালের মে মাসে জমা দেওয়া সেই প্রতিবেদনে উঠে আসে, কোম্পানি থেকে প্রায় ২ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে এবং ৪৩২ কোটি টাকার হিসাব সংক্রান্ত অনিয়ম হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, এমএ খালেক, সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্লাহ এবং কয়েকজন সাবেক পরিচালক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মূলত দুইটি পন্থায় অর্থ আত্মসাৎ করা হয়: একটি হলো বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দামে জমি কেনা এবং অন্যটি কোম্পানির মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিপ্ট (এমটিডিআর) বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ।
এই অনিয়মের প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়। একই সময়ে তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্লাহকেও বরখাস্ত করে আইডিআরএ।
বর্তমানে, গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং আর্থিক দায় পরিশোধের জন্য কোম্পানিটির ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে দেখা যাচ্ছে, সম্পদ বিক্রি কিংবা আয় বৃদ্ধি কোনোটিই যথেষ্ট নয়। আইডিআরএ ও সরকারের যথাযথ নজরদারি ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের পুনরুদ্ধার সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

