বরিশালের বাকেরগঞ্জের চরাদি ইউনিয়নের কৃষক পরিবারের সন্তান নাছির উদ্দিন মল্লিক ১৯৯১ সালে যোগ দেন পুলিশের এসআই পদে। কৃষকের ছেলে থেকে পুলিশের চাকরি তার জীবনে হয়ে ওঠে মোড় ঘোরানোর মাধ্যম। সম্প্রতি বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) সহকারী কমিশনার হিসেবে অবসর নেন তিনি। ৩৪ বছরের চাকরিজীবনে তিনি হয়েছেন বিতর্কিত সম্পদের মালিক। অভিযোগ রয়েছে, এসব সম্পদ ঘুষের অর্থে গড়া।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চাকরির সুবাদে নাছির বরিশাল নগরীর বাংলাবাজার এলাকায় সাড়ে সাত শতক জমি কেনেন। ২০১৮ সালে তিনি সাততলা ভবন নির্মাণের অনুমতি চান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে। ২০১৯ সালে অনুমতি পেলেও ২০২০ সালে সেখানে দাঁড় করান ১০ তলা ভবন। হেডকোয়ার্টার্সে দেওয়া আবেদনে তিনি ভবন নির্মাণের অর্থের উৎস হিসেবে নিজের বেতন ও স্ত্রীর ব্যবসার আয়ের কথা উল্লেখ করেন। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, তার স্ত্রী কখনো কোনো ব্যবসা বা চাকরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
বরিশালের দক্ষিণ সাগরদী এলাকায় নাছির গড়ে তোলেন “নাহিরীন ভ্যালি” নামে এক আলিশান বাংলো। সেখানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন আসবাবপত্র, শৌখিন পাখির ঘর ও পাথরের কারুকাজ। নিজের গ্রাম বাকেরগঞ্জের দুধল ইউনিয়নে নির্মাণ করেছেন দোতলা বাড়ি, যদিও সেখানে কেউ বসবাস করে না। শ্বশুরবাড়ি ঝালকাঠির নলছিটিতেও রয়েছে জমিজমা। পাশাপাশি তার নামে–বেনামে ব্যাংকে এফডিআরের তথ্যও পাওয়া গেছে।
রাজধানী ঢাকায়ও ফ্ল্যাট ও প্লট আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এসবের অবস্থান এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন থানায় ওসি থাকাকালে নাছির রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষকে আসামি করার ভয় দেখিয়ে অর্থ হাতিয়েছেন। ঘুষের টাকা দিয়েই তিনি গড়েছেন বিপুল সম্পদ।
তার গ্রামের বাড়ির তথ্য বলছে, নাছিরের বাবা আনোয়ার হোসেন ছিলেন কৃষক। চার ছেলে ও দুই মেয়ের পরিবারে নাছির মেজো। বড় ভাই দেলোয়ার থাকেন নগরীর সাগরদীতে। ছোট ভাই নান্নু ও চুন্নু কাজ করেন ওষুধ কোম্পানিতে। বোন লাকি মারা গেছেন, আরেক বোন রুনা বেগমের বিয়ে হয়েছে চরাদি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন মল্লিকের সঙ্গে।
ভোলায় সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তার বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ ওঠে। পৌরসভার বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, তিনি বিএনপির কর্মী হওয়ায় নাছির তাকে ভয় দেখিয়ে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। জমি বিক্রি করে তিনি দেন তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা। পুরো টাকা না দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা রিপোর্ট দেওয়া হয়। এ অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করলেও তিনি কোনো প্রতিকার পাননি।
মিজানুর রহমানের দাবি, ভোলায় দায়িত্ব পালনকালে নাছির যেন “সোনার ডিমের হাঁস” হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক দলের বহু নেতাকর্মী হয়রানির শিকার হন। অভিযোগ রয়েছে, ২০২১ সালে ভোলায় ৯৯টি মামলার তদন্তের সময় কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন তিনি।
ভোলা সদর উপজেলার আবুল হোসেন মাজেদ হাওলাদারও অভিযোগ করেন, চাঁদাবাজির মামলায় তার কাছে তিন লাখ টাকা দাবি করেন নাছির। টাকা না দেওয়ায় পুলিশ তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়। অন্যদিকে স্থানীয় ব্যবসায়ী মশিউর রহমানও দাবি করেন, বিএনপি সমর্থক হওয়ায় নাছির তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করেন।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নাছির উদ্দিন মল্লিক। তিনি বলেন, বৈধ টাকা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়েই ভবন নির্মাণ করেছেন। ভবনের নবম তলা পর্যন্ত কাজ শেষ হওয়ার পর পপুলার ডায়াগনস্টিক থেকে ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা অগ্রিম পান। সাগরদীর নাহিরীন ভ্যালিতে যা কিছু আছে, তা পুরোনো জিনিসপত্র। ঢাকায় প্লট ও ফ্ল্যাটের অভিযোগও তিনি নাকচ করেন। তার দাবি, স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন, সেটি তার নিজস্ব নয়।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, “আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

