রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হকের মাজারে শুক্রবার হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক এখনও কাটেনি। মাজারের বন্ধ গেটের সামনে পুলিশের পাহারা চলছে, মাঝেমধ্যে সেনাবাহিনীর ভ্রাম্যমাণ দল টহল দিচ্ছে। কেউ ভিতরে ঢুকতে না পারলেও আশপাশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত মাজারটি দেখতে ভিড় করছেন। সব মিলিয়ে এলাকাটি থমথমে এবং আতঙ্কিত। স্থানীয়রা বলছেন, শুক্রবার হাজার হাজার মানুষ মাজারে হামলা চালিয়েছিল। তাই পুনরায় হামলার আশঙ্কায় দিন কাটছে তাদের।
এই ঘটনায় সরকারি কাজে বাঁধা দেওয়া ও গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে অজ্ঞাতনামা ৩,৫০০ আসামি করে শনিবার পুলিশ একটি মামলা করেছে। ঘটনার সঙ্গে মিল রয়েছে রাজশাহীর পবা উপজেলার একটি খানকা শরিফের হামলার সঙ্গে, যেখানে দলবদ্ধ মব পুলিশের সামনেও ভাঙচুর চালিয়েছে। শুধু মাজার নয়, ধর্ম অবমাননা কিংবা রাজনৈতিক ট্যাগের আড়ালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি একাধিক মব হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন আবার উঠে এসেছে।

অনেকেই অভিযোগ করেছেন, মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দেওয়া হলেও বাস্তবে সেনাবাহিনী ও পুলিশ যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় পুলিশ ও প্রশাসন উভয়ই সংকটে পড়ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যবস্থা নিলে যদি কিছু হয়, এমন ভয় সাধারণ মানুষের মধ্যেও কাজ করছে।
সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, “রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক যে উদ্দেশ্যেই হোক, একবার মব সন্ত্রাস করলে সুযোগ বারবার নেওয়ার প্রবণতা থাকে। বাংলাদেশে সেটিই ঘটছে। সমাজে মব কালচার ছড়িয়ে পড়ছে, যা ছোঁয়াচে রোগের মতো।”
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, আইনশৃঙ্খলা ঠিক করতে হলে পুলিশকেই দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি বলেন, “কাজ করলে পুলিশের চাকরি বা নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা থাকবে না, এই নিশ্চয়তা না থাকলে তারা কীভাবে কাজ করবে? অন্যায় করলে পুলিশেরও বিচার করতে হবে এবং অন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের বিচারও নিশ্চিত করতে হবে।”

মাজারে হামলা-ভাঙচুর, ধর্ম অবমাননা ও রাজনৈতিক ট্যাগের আড়ালে হেনস্তার একাধিক ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা উঠেছে। রাজবাড়ী ও রাজশাহীর ঘটনাগুলোতে পুলিশের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও তারা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। গোয়ালন্দে নুরাল পাগলার মাজার ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে চলা সমস্যা কেন চলতে দেওয়া হয়েছিল, এ বিষয়ে স্থানীয়রা প্রশ্ন তুলেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জুড়ান মোল্লাপাড়া এলাকার একজন বাসিন্দা বলেন, “২৩শে আগস্ট নুরাল পাগলার মৃত্যুর পর থেকেই মাজারটি উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়ায় হামলার ঘটনা ঘটেছে।”
স্থানীয় প্রশাসনের বরাতে জানা যায়, নুরুল হক এক সময় নিজেকে ইমাম মাহাদি দাবি করেছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ মাজারের ভিতরে কয়েক ফুট উঁচুতে দাফন করা হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় আলেম সমাজের সঙ্গে বিরোধ চলছিল।

উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে মাজারে অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ তোলেন। বৃহস্পতিবার, কবর সমতল না করার অভিযোগের প্রেক্ষিতে জুমার নামাজের পর ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। দুই পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও সমাধান হয়নি। প্রশাসন সতর্ক অবস্থান নিয়েছিল, কিন্তু শুক্রবারের ঘটনার আগেই নিয়ন্ত্রণে ফেরা সম্ভব হয়নি।
গোয়ালন্দ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, হামলার দিন মাজারের মূল পয়েন্টে অন্তত ২০ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন মোড়ে, যেমন সোনালী ব্যাংক মোড়, বড় মসজিদ মোড় ও ওয়ালটন মোড়ে পুলিশ টহল দিচ্ছিল। পরিস্থিতি সকাল পর্যন্ত শান্ত ছিল, তবে নামাজের পর হঠাৎ দেশীয় অস্ত্র ও ইট-পাটকেল নিয়ে হামলা হয়।
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার বলেন, প্রশাসন সংলাপের মাধ্যমে সমাধান চেষ্টা করলেও পরিবারের সদস্যদের কালক্ষেপণ এবং সময় নেওয়ায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বাধা তৈরি হয়েছে।

রাজশাহীর পবায় খানকা শরিফে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে। ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে তিন দিনের আয়োজন চলছিল। কয়েকদিন ধরে কিছু মানুষ এই আয়োজনে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিল।
স্থানীয় সাংবাদিক মতিউর মর্তুজা জানান, জুমার নামাজের পর হামলা হতে পারে এমন তথ্য থাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র গাজিউর রহমান বলেন, যারা হামলার সঙ্গে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিবিসির প্রতিবেদন অনুসারে, কেবল মাজারে হামলা নয়, সম্প্রতি মব সন্ত্রাসের আরও কয়েকটি ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ২৮শে আগস্ট ‘মঞ্চ ৭১’ অনুষ্ঠানে “জুলাই যোদ্ধা” পরিচয়ে মব তৈরি করে আলোচকদের হেনস্তা করা হয়। কিন্তু হেনস্তাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে হামলার শিকারদের ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
এর আগে রংপুরের তারাগঞ্জে দুই ব্যক্তিকে মব পিটিয়ে হত্যা করা হয়। একই জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে বহিরাগতরা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাট চালায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উপস্থিত থাকলেও বিশৃঙ্খল জনতাকে থামাতে ব্যর্থ হয়।

‘মব সন্ত্রাস’ নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানা আশ্বাস দিলেও ঘটনাগুলো থামছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব সন্ত্রাস ও শ্রমিক হত্যা নিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি বিবৃতি দিয়েছে। সেখানে সরকারের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারের নিরবতা এবং পুলিশের ভয় অপরাধীদের সুযোগ বাড়াচ্ছে। মবকে নিয়ন্ত্রণ না করলে সাধারণ মানুষ নিজে আইন প্রয়োগের চেষ্টা করতে পারে। পুলিশ নিজস্ব সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ নিরাপত্তার জন্য তাদের ওপর নির্ভর করছে।
সাবেক পুলিশ প্রধান নুরুল হুদা বলেন, “কিছু ঘটনা ঘটবেই, কিন্তু সরকারের আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্ন তৈরি হবে। নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করলে আন্তর্জাতিক মহলেও সরকারের উপর প্রশ্ন উঠবে।”

