বাংলাদেশ রেলওয়ে পরিচালনায় বছরে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করছে সরকার। এর বড় অংশ যাচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, অনবোর্ড সেবা, ইঞ্জিন ও কোচ মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ এবং যন্ত্রাংশ কেনায়। ‘বিশেষ কার্যক্রম’ খাতের এ ব্যয়ের মূল উদ্দেশ্য যাত্রীসেবা উন্নয়ন। কিন্তু বাস্তবে সেবার মান নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ।
অপরিচ্ছন্ন ট্রেন ও স্টেশন, সময়সূচি বিপর্যয়, টিকিট কালোবাজারি, আসনবিহীন যাত্রী, খাবারের অতিরিক্ত দাম—সব মিলিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। ঘন ঘন লাইনচ্যুতি ও ইঞ্জিন-বগি বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনাও বাড়িয়েছে যাত্রীদের উদ্বেগ। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও এসবের তেমন উন্নতি হয়নি।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেলের আয় কমেছে ৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। আয় হয়েছে ১ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা, যা কোভিড-পরবর্তী প্রথম নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের জুলাই মাসে গণ-অভ্যুত্থানের সময় ট্রেন চলাচল বিঘ্নিত হওয়ায় আয় কমে যায়।
তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত মিলেছে। এ সময় রেলের আয় দাঁড়ায় ৫৩২ কোটি টাকা। তবুও লোকসান কমাতে তা যথেষ্ট নয়। প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে রেলের লোকসান দাঁড়াতে পারে ১ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
যাত্রীরা চান সহজে টিকিট পাওয়া, সময়মতো ট্রেন ছাড়ার নিশ্চয়তা, পরিষ্কার ট্রেন ও স্টেশন, আর নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছানো। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। টিকিট সংগ্রহেই শুরু হয় বিড়ম্বনা। জনপ্রিয় রুটের টিকিটের বড় অংশ যায় কালোবাজারিদের হাতে। কেউ টিকিট পান না, কেউ অতিরিক্ত দাম দিয়ে কিনতে বাধ্য হন।
ট্রেনে উঠে নতুন ভোগান্তি। রেলের নিয়ম অনুযায়ী, আসনের ২৫ শতাংশ যাত্রী আসনবিহীন থাকতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে অনেক ট্রেনে টিকিটবিহীন অসংখ্য যাত্রী উঠে পড়ে। বগিতে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। এতে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ তৈরি হয়।
টয়লেটের অবস্থা নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর। কোচ-বগিতে অপরিচ্ছন্নতা চোখে পড়ে সর্বত্র। তার সঙ্গে যুক্ত হয় ট্রেনের সময়সূচি বিপর্যয়, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দুর্ঘটনা।
দেশের প্রধান স্টেশন কমলাপুরেও অবস্থা ভালো নয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, বিশ্রামাগার অপ্রতুল, টয়লেট অপরিষ্কার, ফ্যান অনেক সময় বন্ধ থাকে। বিনামূল্যে টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও সেগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। ভবঘুরেদের আনাগোনা ও চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনাও নিয়মিত।
স্টেশনমাস্টার আনোয়ার হোসেন বলেন, “স্টেশন পরিষ্কার রাখতে আমরা চেষ্টা করি। তবে যাত্রীরা সচেতন না হলে শতভাগ সফল হওয়া সম্ভব নয়।”
শুধু স্টেশন নয়, ট্রেনেও একই অবস্থা। অনেক বগিতে ময়লা, টয়লেট নোংরা, আসন ভাঙা। যাত্রীরা দীর্ঘদিন ধরেই এসব সমস্যায় ভুগছেন।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, “রেলে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে কিন্তু সেবার মানে উন্নতি হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারও দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে পারেনি। সাম্প্রতিক সময়ে লাইনচ্যুতি ও বগি বিচ্ছিন্নের ঘটনা বেড়েছে, যা রক্ষণাবেক্ষণে ঘাটতির প্রমাণ।”
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানও স্বীকার করেছেন রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতা। তিনি বলেন, “রেলের কারখানাগুলো মানসম্পন্ন নয়। কীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে আমরা আলোচনা শুরু করেছি।”
তিনি আরও বলেন, “রেলের লোকজন কাজ করতে আগ্রহী নয়। তবে প্রতিটি স্টেশনে ময়লা ফেলার বিন দেয়া হয়েছে, এতে কিছুটা পরিচ্ছন্নতা বেড়েছে।”
ইঞ্জিন ও কোচ সংকটকেও যাত্রীসেবা ব্যাহত হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি জানান, “নতুন ইঞ্জিন-কোচ পেতে দুই-আড়াই বছর সময় লাগে। ডিসেম্বরে কিছু পাওয়া গেলে সেবার মান কিছুটা বাড়তে পারে।”
ফাওজুল কবির খান দাবি করেন, রেলের আয়-ব্যয়ের অনুপাত (অপারেটিং রেশিও) কিছুটা কমানো গেছে। আগে ১ টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় হতো ২ টাকা ৪০-৫০ পয়সা, এখন তা কমে ১ দশমিক ৮ বা ৯-এ নেমেছে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে রেলের পরিচালন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা। তবে তা অর্জন সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন রেলের মহাপরিচালক আফজাল হোসেন।
তিনি বলেন, “লোকোমোটিভ সংকট ও আমদানিকারকদের কার্যক্রম কমে যাওয়ায় রাজস্ব লক্ষ্য পূরণ সম্ভব নয়।” নতুন প্রস্তাবে লক্ষ্য ৫১৭ কোটি টাকা কমিয়ে ২ হাজার ৬৫৫ কোটি নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে।
তবুও রেলের মহাপরিচালক দাবি করেছেন, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে আগের বছরের তুলনায় আয় বেড়েছে।

