চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার শান্ত শাকপুরা এলাকায় অবস্থিত স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের একটি শাখা ভবনকে ঘিরে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ জাহেদুল হক এবং তার ভাই মোহাম্মদ এনামুল হক। অভিযোগে বলা হয়েছে—অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, ভুয়া খতিয়ান ব্যবহার, প্রকৃত মালিককে ভাড়ার অর্থ থেকে বঞ্চিত করা, এমনকি ব্যাংকের তহবিল থেকেই কর ও ভ্যাট পরিশোধের মতো গুরুতর অনিয়ম হয়েছে।
সম্প্রতি এসব অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস বিভাগে জমা পড়ে। তদন্তের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দিয়েছে।
অভিযোগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, শাকপুরা মৌজার বি এস ৩৩৭০ নম্বর খতিয়ানের জমির ওপর নির্মিত ভবনটির মালিক পাঁচ ভাই—মোহাম্মদ ছাইদুল হক, নেছারুল হক, জাহেদুল হক, এনামুল হক ও জসিমুল হক। কিন্তু ভাড়ার চুক্তিপত্রে পরিচালক জাহেদুল হক ইচ্ছাকৃতভাবে ভিন্ন খতিয়ান ও দাগ নম্বর উল্লেখ করেছেন—যা ভবনের প্রকৃত অবস্থানের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।
ফলে প্রকৃত মালিকদের দুই ভাই ছাইদুল হক ও নেছারুল হক দীর্ঘদিন ধরে তাদের ন্যায্য অংশের ভাড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, যৌথ সম্পত্তিকে একক মালিকানা দেখিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগও উঠেছে জাহেদুল ও এনামুল হকের বিরুদ্ধে।
ভবনটি প্রায় ৩ হাজার বর্গফুট আয়তনের। এর মাসিক ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ৫১ হাজার টাকা—যা স্থানীয় মানদণ্ডে অনেক বেশি। বোয়ালখালী এলাকায় একই আয়তনের ভবনের ভাড়া সাধারণত ৩০ হাজার টাকার মধ্যে সীমিত থাকে। তাছাড়া ভ্যাট ও করও দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকে—যা ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর এই চুক্তি কার্যকর হয়, মেয়াদ আট বছর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে এই পুরো প্রক্রিয়াকে “গুরুতর অনিয়ম” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অভিযোগের আরেকটি বড় দিক হলো—এই জাহেদুল হক এখনো স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের পরিচালক পদে বহাল আছেন। ফলে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না বলে জানা গেছে।
চলতি বছরের ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো অভিযোগে ভাই ছাইদুল হক ও নেছারুল হক স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, “২০১৭ সালের পর থেকে আমাদের অংশের ভাড়া বন্ধ রয়েছে। জাহেদুল হক ভিন্ন দাগের জমি দেখিয়ে ব্যাংককে বিভ্রান্ত করেছেন এবং আমাদের প্রাপ্য টাকা আত্মসাৎ করেছেন।”
স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে জানা গেছে, জাহেদুল হক শুধু ব্যাংক পরিচালক নন, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাও ছিলেন। বোয়ালখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তার প্রভাব এতটাই ছিল যে, গত ১৫ বছরে কেউ প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পায়নি।
গত বছরের ৫ জুলাই শেখ হাসিনা সরকারের পতনের রাতে চট্টগ্রাম নগরের চিটাগং ক্লাবের সামনে তার গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় যুবশক্তি ও এনসিপির নেতা-কর্মীরা। অভিযোগ ছিল—জাহেদুল হকের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত একাধিক হত্যাকাণ্ডের মামলা রয়েছে। সেদিন পুলিশের হস্তক্ষেপে আন্দোলন স্থগিত হলেও, পরে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। সম্প্রতি আবার দেশে ফিরে তিনি প্রকাশ্যেই চলাফেরা করছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
এ ঘটনায় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ভেতরে এখন নীরব অস্থিরতা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুসন্ধান শেষ হলে এই কেলেঙ্কারি হয়তো আরও বড় আকারে সামনে আসবে।

