গ্রামের বাড়িতে একবার দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা হয়। ছোট একটি ইলেকট্রনিকস দোকানে কাজ করেন তিনি। মাসের শেষে নিয়ম করে দুবাই-প্রবাসী ভাইকে টাকা পাঠান। হাসিমুখে জানালেন, ‘টাকা পাঠাতে বাইন্যান্স ব্যবহার করি।’ বললেন এমনভাবে, যেন কোনো বিশেষ শর্টকাট তিনি জেনে গেছেন যা আমাদের অজানা।
সেদিনই প্রথম বাইন্যান্সের নাম শুনেছিলাম। কৌতূহল ভর করে। জানতে চাইলে তিনি ধৈর্য ধরে ধাপে ধাপে বোঝাতে থাকলেন, যেন জীবনের কোনো গোপন কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছেন। প্রথমে দোকানের গ্রাহকদের কাছ থেকে তিনি নগদ টাকা নেন। তারপর সেই টাকা নিজের ব্যক্তিগত মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) অ্যাকাউন্টে অল্প অল্প করে জমা করেন, যাতে সন্দেহ না জাগে। অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট টাকা হলে তিনি বাইন্যান্স অ্যাপে লগইন করে সরাসরি পি২পি মার্কেটপ্লেসে যান। সেখানে ভালো দামে ইউএসডিটি বিক্রি করছেন এমন একজন বিক্রেতা খুঁজে নেন। ইউএসডিটি হলো মার্কিন ডলারের সঙ্গে যুক্ত একটি স্টেবলকয়েন।
এরপর সরাসরি নিজের এমএফএস অ্যাকাউন্ট থেকে বিক্রেতার এমএফএস কিংবা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বিক্রেতা সমপরিমাণ ইউএসডিটি তার বাইন্যান্স ওয়ালেটে পাঠিয়ে দেয়। বিক্রেতা কে বা টাকার উৎস কোথায়—এসব নিয়ে তার কোনও চিন্তা নেই। ওয়ালেটে ইউএসডিটি জমা হলে বাকি কাজ আরও সহজ। তিনি দুবাইয়ে থাকা ভাইকে মেসেজ করেন। ভাইয়ের বাইন্যান্স ওয়ালেট ঠিকানা নেন এবং কয়েক সেকেন্ডেই ক্রিপ্টো পাঠিয়ে দেন। এখানে নেই কোনো ব্যাংক, নেই রেমিট্যান্স চ্যানেলের ঝামেলা, নেই যাচাই-বাছাই।
গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘সব মিলিয়ে পাঁচ মিনিট লাগে।’ তার ভাই দুবাইয়ে অন্য একজন পি২পি ট্রেডারের মাধ্যমে সেই ইউএসডিটি ভাঙিয়ে হাতে দিরহাম পেয়ে যান। কোনো রেকর্ড থাকে না। কর দিতে হয় না। লেনদেন ট্রেস করাও প্রায় অসম্ভব। তাকে জানানো হলে যে এসব কাজ বাংলাদেশের আইনে মানি লন্ডারিং হিসেবে বিবেচিত হয়, তবু তেমন গুরুত্ব দিতে দেখা গেল না। বাইন্যান্স বর্তমানে বিশ্বে অন্যতম জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম। ২০১৭ সালে কেম্যান আইল্যান্ডে নিবন্ধিত এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা চীনা নাগরিক চ্যাংপেং ঝাও। প্ল্যাটফর্মে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মুদ্রা ইউএসডিটি, যা সব সময় মার্কিন ডলারের সমমূল্য ধরে রাখা হয়। তাই এটি ক্রিপ্টো ব্যবসায়ীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিজ্ঞ ক্রিপ্টো ট্রেডারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিনি বলেন, ‘ধরুন, আপনার কাছে টাকা আছে কিন্তু ডলার নেই। তখন বাইন্যান্সে লগইন করে পি২পি অপশন ব্যবহার করেন। সেখান থেকে ব্যাংক ট্রান্সফার, বিকাশ, নগদ বা রকেটের মাধ্যমে ক্রিপ্টো কেনা যায়।’ তিনি আরও জানান, ‘ক্রিপ্টো কেনার সময় আপনাকে আগে টাকা পাঠাতে হয়। বাইন্যান্স তখন সেই ক্রিপ্টোকে এসক্রোতে রেখে নিরাপদ করে। ফলে বিক্রেতা টাকা নিয়ে পালাতে পারে না। একইভাবে বিক্রি করার সময় আপনি আগে টাকা পান। ক্রিপ্টো বাইন্যান্সের ভেতরেই লক থাকে, লেনদেন শেষ হলে মুক্ত হয়। বিষয়টি আরও সহজ করে বোঝাতে ওই ট্রেডার বলেন, ‘মনে করেন আপনি ১০ লাখ টাকার ইউএসডিটি কিনলেন। এরপর তা যেকোনো দেশে পাঠানো যায়। অনেকটাই হুন্ডির মতো। আপনার ওয়ালেট ঠিকানা দিলেই আমি মুহূর্তে টাকা পাঠাতে পারব। বাংলাদেশ সরকার এটা থামাতে পারবে না।’
২০২৩ সালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এই নেটওয়ার্কের কার্যক্রম শনাক্ত করে। তদন্তে দেখা যায়, বিভিন্ন এমএফএস অ্যাকাউন্টে শত শত কোটি টাকা ঘুরেছে। শুধু একটি মোবাইল নম্বর দিয়েই লেনদেন হয়েছে ২৫ কোটি টাকার বেশি। এ সময় উল্লেখযোগ্যভাবে আলোচনায় আসে বাইন্যান্সের প্রতিষ্ঠাতা চ্যাংপেং ঝাও—যিনি জেলে বসেই বিশ্বের ২৪তম শীর্ষ ধনী এবং সবচেয়ে ধনী কয়েদি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ২০১৪ সালে বিটকয়েন লেনদেনকে অবৈধ ঘোষণা করে। তবুও ধারণা করা হচ্ছে, দেশে এখন অন্তত ৪০ লাখ ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারকারী রয়েছে। সিআইডির তথ্য বলছে, জুয়া, হুন্ডি, পাচার, সাইবার চাঁদাবাজি—সব ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ধরনের ক্রিপ্টো বা ভার্চুয়াল মুদ্রার ব্যবহার বাড়ছে। মাঝে মাঝে অভিযান হলেও এসব নেটওয়ার্ক নতুন রূপে আবার সক্রিয় হয়।
কেন থামানো যাচ্ছে না?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ ইনফরমেশন টেকনোলজির (আইআইটি) পরিচালক অধ্যাপক ড. বি এম মইনুল হোসেন বলেন, ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি অনেকটা ইমেইল পাঠানোর মতো। যেকোনো জায়গা থেকে কেউ যেভাবে ইমেইল পাঠাতে পারে, তেমনি ক্রিপ্টো পাঠানোও খুব সহজ। সরকার ইমেইল নিষিদ্ধ করলেও ভিপিএন বা পি২পি দিয়ে তা চালানো সম্ভব। ক্রিপ্টোর ক্ষেত্রেও একই কথা।’ তিনি আরও বলেন, ইন্টারনেট থাকলে ক্রিপ্টো লেনদেন পুরোপুরি থামানো সম্ভব নয়, কারণ এর পেছনে কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ নেই।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের তথ্য আমাদের হাতে এসেছে। একটি ক্রিপ্টো প্ল্যাটফর্ম স্থানীয় এক ব্যাংকের এনআইডি–সংযুক্ত এপিআই ব্যবহার করছিল। শনাক্ত করার পর এনআইডি কর্তৃপক্ষ সেটি বন্ধ করে দেয়। তবে একই ধরনের প্রক্সি এপিআই এখনও ব্যবহৃত হতে পারে।’ তিনি আরও জানান, অনলাইন জুয়ার টাকা বা সন্দেহজনক লেনদেন ক্রিপ্টোর মাধ্যমে সরানো হচ্ছে কিনা—তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
বিশ্বব্যাপী ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে অর্থ পাচার এখন বড় উদ্বেগ। ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) ও দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের তদন্তে উঠে এসেছে, গত দুই বছরে অন্তত ২৮ বিলিয়ন ডলারের অবৈধ অর্থ প্রধান ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জগুলোতে লেনদেন হয়েছে। উত্তর কোরিয়ার হ্যাকার গ্রুপ, আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্র, সাইবার অপরাধী নেটওয়ার্ক—সবার কাছেই বাইন্যান্স, ওকেএক্স, বাইবিটের মতো প্ল্যাটফর্ম অবৈধ অর্থ পাচার ও তা সাদা করার সহজ পথ হয়ে উঠেছে। তাই বিশ্বের বড় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো নিষিদ্ধ না করে মনোযোগ দিচ্ছে নিয়ন্ত্রণে। যেখানে ডিজিটাল টাকা বাস্তব আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে মিশে যায়, সেখানে কঠোর নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) দেশগুলোকে বাধ্য করছে তাদের ভার্চুয়াল অ্যাসেট সার্ভিস প্রোভাইডার—এক্সচেঞ্জ, পি-টু-পি প্ল্যাটফর্ম, ওয়ালেট সার্ভিস—কেওয়াইসি, রিপোর্টিং এবং আন্তর্জাতিক তথ্য বিনিময়ের আওতায় আনতে।
ইইউ, যুক্তরাজ্য ও ইউএই-তে এসব আইন ইতোমধ্যে কার্যকর। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাইকা আইন লেনদেনে পূর্ণ স্বচ্ছতা বাধ্যতামূলক করেছে। যুক্তরাজ্যে সন্দেহজনক কোনো লেনদেন হলে তা স্থগিত করার নির্দেশ রয়েছে। আর দুবাই, আবুধাবি, বাহরাইনে এক্সচেঞ্জগুলোকে লাইসেন্স, মূলধন এবং অর্থ পাচারবিরোধী আইন কঠোরভাবে মানতে হয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার শূন্যতা যতদিন থাকবে, অপরাধীরা এর সুযোগ নেবে। আর গ্রামের সেই তরুণের মতো সাধারণ মানুষ অজান্তেই জড়িয়ে পড়বে অদৃশ্য এক লেনদেন চক্রে।

