ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী পদে বসার মাত্র আট মাসের মাথায় শেখ হাসিনার পতন ঘটতে পারে এমন ধারণা পলাতক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহিনের কাছে ছিল না। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দুপুরের পরও তিনি আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে নিয়ে সম্প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হাসিনাকে আইনগত সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেন। সেনাপ্রধানের ভাষণের পর একটি রায় দিতে হতে পারে—এমন নির্দেশনা ছিল হাসিনার পক্ষ থেকে। একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা গণভবন ত্যাগ করার পর ওবায়দুল হাসান ভারতে পালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবন ছেড়ে কাকরাইলের জাজেস কমপ্লেক্সে যান। এ সময় তার পরনে ছিল লুঙ্গি আর গেঞ্জি। আত্মগোপনে থেকে তিনি সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট রেফারেন্স সভা আহ্বান করেন। সরকারের উপদেষ্টা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা ওই ফুল কোর্ট সভাটিকে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও ভারতের চক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করেন। সরকারের পদক্ষেপ ও শিক্ষার্থীদের দৃঢ় অবস্থানের ফলে শেষ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধান বিচারপতির আহ্বানকৃত সভাটি পণ্ড হয়।
ছাত্র আন্দোলন দমনসহ হাসিনার অবৈধ ও নিবর্তনমূলক নির্বাহী আদেশের অন্যতম সহযোগী ছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তার পলায়ন, ফুলকোর্ট রেফারেন্স সভা আহ্বান এবং পদত্যাগসহ নানা বিষয় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী, আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা এবং প্রধান বিচারপতির বাসভবন তদারকির দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা এই তথ্য দিয়েছেন।
তাদের বক্তব্যে উঠে আসে হাসিনার গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার পেছনে ওবায়দুল হাসানের ভূমিকা। তিনি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে ১১টি মামলার ফরমায়েশি রায় দিয়েছেন, নিজের ভাইকে দুই দফায় বিনাভোটে এমপি বানিয়েছেন, বিতর্কিত দুটি নির্বাচন কমিশন গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। এছাড়া ডিবি হারুনের কাছ থেকে তরবারি এবং ছাত্রলীগ নেতাদের কাছ থেকে ফুলের তোড়া নেওয়া—সব মিলিয়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের চিত্র দেখা যায়।
হাসিনার পতন ও পলায়নের আগে এবং পরে তাকে রক্ষায় ওবায়দুল হাসানের নানা উদ্যোগ ও পদক্ষেপের কথাও তার সঙ্গে বিচারিক দায়িত্ব পালনকারী কয়েকজন বিচারপতি তুলে ধরেছেন। এসব অভিযোগ জানতে চাইলে ওবায়দুল হাসানকে একাধিকবার কল করা হয়। তবে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
পরশু নয়, কালকেই লংমার্চ:
২০২৪ সালের আগস্টের শুরুতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের পক্ষ থেকে এক দফা দাবিতে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। মূলত লংমার্চের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ৬ আগস্ট। তবে কিছুটা পরিবর্তন করে ৪ আগস্টের জন্য আগাম ঘোষণা করা হয়—‘পরশু নয়, কালকেই লংমার্চ টু ঢাকা’।
প্রধান বিচারপতির দপ্তরের সঙ্গে সংযুক্ত একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ৫ আগস্টের এই সাত শব্দের কর্মসূচি রাত থেকেই ওবায়দুল হাসানকে বিচলিত করে তোলে। ওবায়দুল হাসানের সঙ্গে আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চের বিচার কার্যক্রমে অংশ নেওয়া একজন বিচারপতি বলেন, “পরিস্থিতি আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। ৬ আগস্ট লংমার্চ ধরে আমরা আদালতের কার্যক্রম ঠিক করি। কিন্তু ৪ আগস্ট রাতে যখন ঘোষণা করা হয়, ‘পরশু নয়, কালকেই লংমার্চ’, আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। রাতেই প্রধান বিচারপতির আয়োজনে দু’দফায় ভার্চুয়াল বৈঠক করা হয়।” তিনি আরও জানান, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রাজনৈতিক হলেও প্রধান বিচারপতি তা আদালতে টেনে আনার চেষ্টা করেন। “আন্দোলন করে উচ্চ আদালতের রায় পাল্টানো যাবে না, প্রধান বিচারপতির এমন মন্তব্য ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে।
হাসিনার পতনের ৫ দিন আগে, অর্থাৎ ৩১ জুলাই, দেশব্যাপী ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। ওইদিন সুপ্রিম কোর্টে ব্যাপক হাঙ্গামা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী সুপ্রিম কোর্টের গেট ভেঙে আদালত কক্ষে প্রবেশ করে। ৪ আগস্টের শেষ ভার্চুয়াল বৈঠকে এইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তাই ৫ আগস্ট আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রাখলেও প্রয়োজনে ভার্চুয়ালি আপিল বিভাগের কার্যক্রম চালানোর প্রস্তুতি রাখা হয়।
হাসিনার পক্ষ থেকে ৫ আগস্ট রায় দেওয়ার নির্দেশনা ছিল:
সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আদালতের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সকাল থেকে রাজধানীর কাকরাইল মসজিদ সংলগ্ন ১৯ হেয়ার রোডের সরকারি বাসভবনে অস্থির সময় কাটান।
সুপ্রিম কোর্ট বিচার প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা জানান, আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও প্রধান বিচারপতি বাসভবনে বসে রায় লিখাসহ অন্যান্য দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রথা অনুযায়ী আমরা তাকে সহযোগিতা করতাম। ওইদিনও আনুমানিক ১০টার দিকে আমরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে পৌঁছাই। ১১টা পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। কোনো জায়গা থেকেই লোক সমাগমের খবর পাইনি।
কিছুক্ষণ পর আমাদের বলা হয়, চারদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ বিশাল মিছিল নিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করছে। ওই সময় প্রধান বিচারপতি ভেতরের খাস কামরায় অবস্থান করছিলেন। সাড়ে ১২টার দিকে জানা যায়, পুরো ঢাকা শহরে লাখ লাখ মানুষ বিভিন্ন দিক থেকে শাহবাগ ও শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছেন। বিষয়টি প্রধান বিচারপতিকে জানানোর পর তিনি বিচলিত হলেও আমাদের ছাড়ছিলেন না।
রায়ের বিষয়ে হাসিনার নির্দেশনার কথা জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, বেলা ১টার দিকে খবর আসে, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। সংবাদটি প্রধান বিচারপতিকে জানানো হলে তিনি লাল টেলিফোনে কারো সঙ্গে কথা বলেন এবং কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। এরপর আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক হওয়ার কথা জানানো হলে আমরা ব্যবস্থা করি। বৈঠকে সেনাপ্রধানের ভাষণ ও শেখ হাসিনার একটি নির্দেশনা নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে বলা হয়, “সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর আবারও ভার্চুয়াল বৈঠক হবে।” প্রয়োজনে রায় দিতে হতে পারে—এর ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। তবে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের আগেই হাজার হাজার মানুষের মিছিল প্রধান বিচারপতির বাসভবনের দিকে ধেয়ে আসছে। এমন সংবাদ পাওয়ার পর আমরা নিজ দায়িত্বে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করি।
ওবায়দুল হাসানের বাসভবনে দায়িত্ব পালনকারী গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক কর্মচারী জানান, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তার স্ত্রী ও মা ছিলেন। দুই পাশের দুটি গেটে ১৫–১৬ জন পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। রমনা থানা থেকেও বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল। তবে বেলা আড়াইটার কিছু পরে সব পুলিশ অস্ত্র ও নিরাপত্তা নিয়ে বাসভবন ছেড়ে চলে গেলে এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এর কিছু সময় পর আমরাও সেই এলাকা ত্যাগ করি।
লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে পালান ওবায়দুল হাসান:
নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ, গৃহ পরিচারিকা, খানসামা, আর্দালি ও ব্যক্তিগত সহকারীরা ৫ আগস্ট পরিস্থিতি আঁচ করে দ্রুত নিজের দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যান। বাসভবনে তখন থাকেন ওবায়দুল হাসান, তার স্ত্রী নাফিসা বানু এবং মা বেগম হোসনে আরা হোসাইন। হাসিনার নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে তিনি হেয়ার রোডের বাড়িতে অবস্থান চালিয়ে যান।
তার সঙ্গে বিচারিক দায়িত্ব পালনকারী একজন বিচারপতি জানান, সকাল থেকেই আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলাম। দুপুরের পর পরিস্থিতি খারাপ হলে আমরা তাকে বাসভবন ত্যাগের অনুরোধ করি। কারণ ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির বাসভবনকে কেন্দ্র করে বড় ঘটনা ঘটেছিল। এছাড়া শিক্ষার্থীদের বিষয়ে তিনি উন্মুক্ত আদালতে অনেক বিষোদ্গার ও তাচ্ছিল্যমূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন। এসব স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমরা তাকে নিরাপদে বের হওয়ার পরামর্শ দিই। কিন্তু তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সেখানেই থাকার কথা জানান।
বিচারপতির বর্ণনায়, বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে লাখো মানুষের মিছিল বাসভবনের কাছে পৌঁছালে প্রধান বিচারপতি ভীষণ ঘাবড়ে যান। তিনি ফোন করে উদ্ধারের অনুরোধ করেন। জাজেস কমপ্লেক্সে থাকা অ্যাম্বুলেন্স তাকে উদ্ধার করতে পাঠানো হলে তিনি স্ত্রী ও মাকে নিয়ে পূর্বপাশের গেট দিয়ে মগবাজারের দিকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। রমনা থানার সামনে আটকা পড়েন। পরে ইউটার্ন করে জাজেস কমপ্লেক্সে ফিরে আসেন। এরপর ৮–১০ জন বিচারপতি তাকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে একটি বাংলোতে নিরাপদে নিয়ে যান। ওই সময় তার পরনে ছিল লুঙ্গি ও গেঞ্জি। পরে হাইকোর্টের একজন বিচারপতির বাসায় তাকে নেওয়া হয়। রাত সাড়ে ৮টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে জাজেস কমপ্লেক্স থেকে বের হন। বিচারপতির বর্ণনায়, প্রধান বিচারপতি বাসভবন থেকে বের হওয়ার মাত্র দুই-তিন মিনিটের মধ্যে বিপুল ছাত্র-জনতা সেখানে ঢুকে পড়ে।
ফুলকোর্ট রেফারেন্স মিটিং: বিতর্ক ও বিরোধিতা:
শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার তিনদিন পর, ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টা শপথ নেন। ৯ ও ১০ আগস্ট সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় উপদেষ্টারা ১১ আগস্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেবেন—এমন ঘোষণা আসে সরকারের পক্ষ থেকে।
কিন্তু সরকারের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার আগেই, ১০ আগস্ট তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের নিয়ে ফুলকোর্ট রেফারেন্স সভা আহ্বান করেন। এ মিটিংকে ‘অজ্ঞাত এজেন্ডা’ নিয়ে বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত করেন হাইকোর্ট বিভাগের ১১ জন বিচারপতি। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগের ৭৯ জন বিচারপতি এই সভা নিয়ে একমত পোষণ করেন, জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচার প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতির ডাকা ওই সভার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। তারা বলেন, সকালেই তাদের বলা হয় প্রধান বিচারপতি একটি মিটিং ডেকেছেন। সকাল ৮টায় সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে গিয়ে দেখা যায়, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভার্চুয়াল মিটিংয়ের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছেন। ১০ থেকে ১১ জন বিচারপতি সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলেন কিন্তু তিনি এজেন্ডা সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি জানান, “আমি প্রধান বিচারপতিকে বলেছি, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। নতুন সরকার গঠনের বিষয়ে আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপতির কাছে একটি অভিমত দিয়েছে। আপনার অবস্থানও অজ্ঞাত। কোথায় আছেন, সেটা আমাদের কাছে বলা হয়নি। দেশে এখন সরকার গঠন হয়েছে। আগে দেশটা স্থিতিশীল হোক, তারপর এ ধরনের মিটিং করা যাবে। এখন এমন মিটিংয়ের কোনো যৌক্তিকতা নেই।” ফুলকোর্ট রেফারেন্স সভা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “প্রধান বিচারপতি কারও সঙ্গে পরামর্শ করেননি। মনে করা হচ্ছে, এটি স্বৈরাচারী পরাজিত শক্তির একটি চাল।”
ওবায়দুল হাসানের ফুলকোর্ট মিটিং পণ্ড হওয়ার গল্প:
সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট রেফারেন্স মিটিং আহ্বানকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ১০ আগস্ট সকাল সাড়ে ৮টায় আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল আইন দপ্তরে যোগ দেন। আইন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ওইদিন শনিবার হওয়ায় সচিবালয় পুরোপুরি ফাঁকা ছিল। আমরা জানতে পারি, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী প্রধান বিচারপতির ‘ফুলকোর্ট রেফারেন্স মিটিং’ ডাকার প্রতিবাদে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করেছেন। তারা প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিও করেন। এই অবস্থায় আইন উপদেষ্টা আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নিজ দপ্তরে বসে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আইন উপদেষ্টা দপ্তরে যোগ দিয়ে বিচার বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। এছাড়া তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগের অনুরোধ জানান।
ফুলকোর্ট সভা স্থগিত করা এবং প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আসিফ বলেন, “প্রধান বিচারপতি নিজে ফুলকোর্ট সভা ডেকেছিলেন। কিছু বিষয়ে প্রশ্ন ছিল। বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, আন্দোলন করে রায় পরিবর্তন করা যায় কি না। এটি মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। এছাড়া তিনি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর ছাত্রলীগ থেকে ফুলের শুভেচ্ছা পেয়েছিলেন। এটি আচরণবিধির লঙ্ঘন। তিনি ডিবি পুলিশের সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদের কাছ থেকে সোনার তরবারি পেয়েছিলেন। বিদেশে গেলে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাসায় থাকতেন। এসব কারণে বিতর্ক ছিল।”
অধ্যাপক আসিফ আরও বলেন, “এত বড় গণআন্দোলন হলো, যার মাধ্যমে ১৬–১৭ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, সেটা প্রধান বিচারপতির ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলাম।” অবশেষে ব্যাপক বিতর্কের মুখে ওইদিন বিকেলে ফুলকোর্ট রেফারেন্স সভা বাতিল করা হয়। ওবায়দুল হাসান প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অব্যাহতি নেন। ওই মাসেই তার পাসপোর্টও বাতিল করা হয়, জানায় পাসপোর্ট অধিদপ্তর।
হারুনের তরবারি ও ছাত্রলীগের ফুলে আপ্লুত ওবায়দুল:
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি থেকে ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ওবায়দুল হাসান প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে, ১৯ সেপ্টেম্বর, তাকে ছাত্রলীগের পলাতক সভাপতি সাদ্দাম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। এই ঘটনা দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করে।
সমালোচনার মধ্যেই ২৮ সেপ্টেম্বর ওবায়দুল হাসানকে তরবারি উপহার দেন আলোচিত ‘ভাতের হোটেলের মালিক’ খ্যাত ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ। ওই সময় ডিবি প্রধান বলেন, “আমাদের গর্বের ও অহংকারের নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান একজন গুণী মানুষ। তিনি তরবারি গ্রহণ করায় আমিও গর্বিত।”
নিজে হন প্রধান বিচারপতি, ভাইকে বানান এমপি:
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ওবায়দুল হাসান ১৯৯৬ সালে দলের মনোনয়নে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তী সময়ে তিনি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাকে হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুই বছর পর হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হন। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামের নেতাদের বিচারের দায়িত্ব পান। চেয়ারম্যান হিসেবে ১১টি মামলার রায় দেন তিনি।
২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তাকে দেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের রাতের ভোট ও ২০২৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের আগে তিনি নির্বাচন কমিশন গঠনে অনুসন্ধান কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। উচ্চ আদালতের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তার ছোট ভাই সাজ্জাদুল হাসানকে নৌকা প্রতীকে দুইবার জাতীয় সংসদে নির্বাচিত করানোর ক্ষেত্রে তার ভূমিকা নেট্রকোনাবাসীর মুখে মুখে আলোচিত।
সূত্র জানায়, সাজ্জাদ ২০১৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হন। ২০২২ সালে তিনি দেশের বড় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ‘মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’ দখলেও ভূমিকা রাখেন।
২০২৩ সালের ১১ জুলাই নেত্রকোনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য রেবেকা মমিন মারা গেলে ওই আসনে আওয়ামী লীগ সাজ্জাদকে বিনা ভোটে সংসদ সদস্য করে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি আবারও এমপি নির্বাচিত হন। নির্বাচনের দিন মোহনগঞ্জ মহিলা কলেজ কেন্দ্রে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ভোট দিতে গিয়ে ওবায়দুল হাসান সাংবাদিকদের জানান, “দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটার উপস্থিতি আরো বাড়বে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে দেশ এগিয়ে যাবে।”

