সারা দেশে হত্যাসহ নানা ধরনের অপরাধের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানাচ্ছে, প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১২টি হত্যাকাণ্ড ঘটছে। বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, খুনের সংখ্যা দিন দিন দ্বিগুণ হারে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব নৃশংস হত্যার সঙ্গে মাদক জড়িত।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, মাদকাসক্তরা নৈতিকতা ভুলে যায়। মাদক তাদের জীবনের আনন্দ ও বিনোদনের সঙ্গী হওয়ায় অপরাধের পথেও তারা প্রবণ। অনেক সময় মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পরও তারা উৎসবের মতো আচরণ করে। সংবাদপত্রে এমন ঘটনা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী মোবাইলে পর্নোগ্রাফি দেখার সঙ্গে একগুচ্ছ হয়ে আসক্ত হয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে অনেকেই ইয়াবার প্রতি আসক্ত। লেখাপড়া ছেড়ে এই তরুণরা বিপথগামী হচ্ছে। তদন্তে দেখা গেছে, তারা গ্রুপ করে ইয়াবা সেবন করছে এবং একপর্যায়ে নৃশংস অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
সম্প্রতি রংপুরে ব্যবসায়ী আশরাফুলকে তার বন্ধু জরেজ মিয়া শনিরআখড়ায় বান্ধবীর বাসায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। পরে লাশ ২৬ টুকরা করে ড্রামে ভরিয়ে হাইকোর্ট এলাকায় ফেলা হয়। হত্যাকারী জরেজ মিয়া স্বীকার করেছেন, হত্যার পর তিনি তার বান্ধবীর সঙ্গে যৌনকর্মও করেছেন। চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায় ২২ নভেম্বর পারিবারিক বিষয় নিয়ে বাবা-ছেলের মধ্যে বিবাদে আব্দুল খালেককে ছেলে মোহাম্মদ হোসাইন প্রকাশ্যে দা দিয়ে হত্যা করেছে। দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে।
সম্প্রতি খুলনা মহানগরের দায়রা জজ আদালতের প্রধান ফটকের সামনে হাসিব ও রাজন নামে দুই যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। তারা এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং মাদক ব্যবসায়ী পলাশ গ্রুপের সদস্য ছিলেন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মাদক ব্যবসার বিরোধে তাদের হত্যা করা হয়েছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে প্রায় প্রতিরাতে মাদক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বোমাবাজি ও গোলাগুলি ঘটছে। সম্প্রতি ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বুনিয়া সোহেলকে সেনাবাহিনী আটক করেছে। প্রতিদিনই সারা দেশে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব হত্যার সঙ্গে মাদকাসক্তদের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, মাদকাসক্তরা হত্যা করছে কাকে—এই সচেতনতা তাদের থাকে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, দেশে সংঘটিত বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড ও অপরাধ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং মাদকাসক্ত অবস্থায় অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। অপরাধীদের অপরাধ করার সময় কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তারা মানুষকে হত্যা করে টুকরা টুকরা করার পরও তা নিয়ে উল্লাস করে।
তিনি আরও বলেন, মাদক প্রতিরোধে রাষ্ট্র জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অফলাইন বা অনলাইনে মাদকের সরগরম উপস্থিতি সব জায়গায় দৃশ্যমান। মাদককে কেন্দ্র করে দেশে এক বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে, যা ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিজের পরিবার ও রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। মাদক নির্মূল ছাড়া এই অভিশাপ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় একটি অংশ ইতিমধ্যেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। যদি এই ভয়াবহ অবস্থা চলতে থাকে, তবে ভবিষ্যতে দেশের প্রশাসন ও সকল পেশায় যোগ্য ও মেধাবী লোকের তীব্র সংকট দেখা দেবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সর্বনাশা মাদককে রুখতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সমাজের সব পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি মাদক ব্যবসায়ী ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
দেশে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও অপরাধের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর সঙ্গে মাদকাসক্তদের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, মাদকাসক্তরা হত্যার সময় কোনো সচেতনতা প্রদর্শন করে না। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, ‘মাদকাসক্তদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলগামী ছাত্রদের মধ্যে ইয়াবা আসক্ত কম নয়। এসব কারণে অপরাধ বেড়ে চলছে। টুকরা টুকরা করে হত্যা করলেও খুনিদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা দেখা যায় না।’
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কোনো এলাকা নেই যেখানে মাদক পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে ইয়াবা। প্রতিটি গ্রামে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হচ্ছে। মোটরসাইকেলযোগে গ্রামের পর গ্রাম তরুণরা সরবরাহ করছে। এর ফলে গ্রামাঞ্চলে হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি ও চাঁদাবাজি বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এই সত্যতা স্বীকার করেছে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের একটি অংশ জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ করছে প্রচুর। তরুণ ও কিশোররা সবচেয়ে বেশি আসক্ত হচ্ছে। তবে উদ্ধারকৃত মাদকের পরিমাণ প্রতিদিন সামান্য, যা সমুদ্রের এক ফোঁটা পানির মতো। কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া মাদক নির্মূল সম্ভব নয়।
র্যাবের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে গত এক সপ্তাহে ৬০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী, খুন, চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অপরাধে জড়িতদের তালিকা অনুযায়ী অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. ছিবগাতউল্লা জানিয়েছেন, সিআইডি নৃশংস হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য অপরাধে জড়িতদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত গ্রেফতার করছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আরও আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে, যাতে অপরাধীরা লুকিয়ে থাকতে না পারে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, মাদক নির্মূল না হলে দেশের সামাজিক, শিক্ষাগত ও পেশাজীবন ক্ষেত্রে গুরুতর সংকট দেখা দিতে পারে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সমাজের সকল পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পরামর্শ দিচ্ছেন।

