চট্টগ্রামে অবৈধ সিগারেট ও নকল ব্যান্ডরোলবিরোধী অভিযানের পর কাস্টমসের দুই কর্মকর্তার ওপর সশস্ত্র হামলার ঘটনায় তদন্তকারীদের নজর এখন এক প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের দিকে। এই সিন্ডিকেটটির নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
হামলার শিকাররা দাবি করেছেন, আগেই তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এরপর কয়েকদিন ধরে তারা অচেনা মোটরসাইকেলে অনুসরণও করা হচ্ছিল। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সিডিএ আবাসিক এলাকায় তাদের গাড়ি থামিয়ে সশস্ত্র হামলা চালানো হয়। হামলার পর তারা এখন অনিরাপত্তায় ভুগছেন।
হামলার শিকার দুই কর্মকর্তার একজন রাজস্ব কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান খান জানান, “আমরা নিয়মিত কার্যক্রম শেষ করে বের হচ্ছিলাম। হঠাৎ দু’দিক থেকে মোটরসাইকেলে থাকা কয়েকজন আমাদের পথরোধ করে। প্রথমে গালিগালাজ, তারপর কোনো সুযোগ না দিয়ে হামলা শুরু করে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের ওপর নজরদারি চলছিল। ঘটনার ধরন দেখে নিশ্চিত হচ্ছি, এটি পরিকল্পিত হামলা। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অবৈধ চালান আটকানোর ঘটনায় একটি চক্রের নাম সামনে এসেছে। সেই কারণে চক্রটি আমাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল। আমরা জানতাম চাপ আসতে পারে, কিন্তু এভাবে সশস্ত্র হামলা করবে ভাবিনি। হামলার পর থেকে আমরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় দিন পার করছি।”
হামলার অপর শিকার কর্মকর্তা হলেন—সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) বদরুল আরেফিন। তদন্তে উঠে এসেছে, চট্টগ্রামের অবৈধ সিগারেট সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছেন নওফেল এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটন ও তার ভাই। গত ২৫ নভেম্বর পটিয়া কাস্টমস টিম প্রায় সাত লাখ অবৈধ বিড়ি-সিগারেট জব্দ করে। এছাড়া মে মাসেও প্রায় ৩০ কোটি টাকার নকল ও অবৈধ সিগারেট জব্দ করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সিন্ডিকেট কর্মকর্তারা ‘খুন’ করার পরিকল্পনা নেয়।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের অবৈধ সিগারেট বাজারের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো ও তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো। লিটন ও তার ভাইয়ের মালিকানায় রয়েছে আরও কিছু কোম্পানি। এর অঘোষিত নিয়ন্ত্রক নওফেল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর তারা নিজেও পালিয়ে যান। বহুদিন ধরে কোম্পানিগুলো নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। এনবিআরের সিআইসি তদন্তেও একই তথ্য পাওয়া গেছে।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের মতে, ধারাবাহিক অভিযানে নওফেল–লিটন চক্রের অবৈধ সিগারেটের বাজার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত চার মাসে বিপুল পরিমাণ নকল সিগারেট ও কাঁচামাল জব্দ হয়েছে। কর্মকর্তারা শুধু গুদাম থেকে পণ্য ধরেননি, বরং বিভিন্ন কোম্পানির আমদানি নথি, ব্যাংক হিসাব ও চালানের অসংগতি মিলিয়ে পুরো নেটওয়ার্ক উন্মুক্ত করেছেন। সিআইসি, শুল্ক গোয়েন্দা এবং কাস্টমস—তিনটি সূত্রের তথ্য মিলিয়ে নিশ্চিত হয়েছে, একই গোষ্ঠী একই কাঁচামাল আমদানি করে বাজারে নকল সিগারেট ছড়াচ্ছে।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে আরও বড় চিত্র। কাঁচামাল আমদানিতে মালয়েশিয়া–দুবাই রুট এবং বিতরণে কক্সবাজার–টেকনাফ রুট ব্যবহারের তথ্য মিলেছে। নকল বিদেশি ব্র্যান্ডের সিগারেট বাজারে ছড়ানো ও ব্যান্ডরোল জালিয়াতির সঙ্গে সীমান্তভিত্তিক চক্র জড়িত থাকার প্রমাণও পাওয়া গেছে। ফলে কাস্টমস কর্মকর্তারা শুধু স্থানীয় সিন্ডিকেট নয়, আন্তর্জাতিক চোরাচালান নেটওয়ার্কেরও চোখের কাঁটা হয়ে উঠেছেন।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের মুখপাত্র এইচএম কবির জানান, “অবৈধ সিগারেট সিন্ডিকেটকে ঘিরে যে পরিমাণ আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও পাচার–নেটওয়ার্ক সক্রিয় আছে, তা আগে এত বড় পরিসরে আমরা দেখিনি। আমাদের কর্মকর্তারা নিয়মিত ঝুঁকি নিয়ে মাঠে কাজ করছেন। সাম্প্রতিক সশস্ত্র হামলা প্রমাণ করে, এরা ব্যবসায় আঘাত করলে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার পথেও নামতে পারে। তবু কাস্টমস পিছু হটবে না। তদন্ত ও অভিযান আগের চেয়ে আরও বাড়ানো হবে।”
তিনি আরও বলেন, “অভিযানে সামনের সারিতে ছিলেন হামলার শিকার ওই দুই কর্মকর্তা। তাই তাদের থামাতেই এই হামলা চালানো হয়।” ডবলমুরিং থানার ওসি বাবুল আজাদ জানিয়েছেন, “হামলায় জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। আমরা মামলাও নিয়েছি। জড়িতদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।”

