একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নাম প্রকাশ পাচ্ছে। কেউ রক্ষকের বদলে ভক্ষক হয়ে নিজেই ইয়াবা কারবারে জড়িয়েছেন, কেউ মাদকাসক্ত হয়েছেন, আবার কেউ টাকা নিয়ে আসামি ছাড়ছেন। এ ছাড়া অভিযানের সময় টাকা লুট, জব্দ ইয়াবা গায়েব করা, নির্দোষ ব্যক্তিকে মাদক দিয়ে ফাঁসানো—এসবও ঘটেছে। চাকরি ছাড়ার পর ‘নথিপত্র জালিয়াতি’ করে এক কর্মীকে পুনর্বহালের অভিযোগও পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিয়েছে, তবু অনিয়ম থামছে না।
ডিএনসি সূত্র জানায়, চলতি বছর এ পর্যন্ত শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডের কারণে ৫৭টি বিভাগীয় মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে এক বছরের ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করা হয়েছে, আরেকটিতে শুধু তিরস্কার, যা লঘুদণ্ড হিসেবে ধরা হয়। বাকি ৫৫ মামলার কার্যক্রম এখনও চলমান। ডিএনসির সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মোস্তাক আহমেদ বলেন, “অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে তা শুধু সাময়িক নয়। তদন্ত চলছে, বিভাগীয় মামলা চলছে। যেমন টাঙ্গাইলের ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের সাময়িক বরখাস্তের পাশাপাশি তদন্ত চলছে।”
সংশ্লিষ্টরা জানান, সম্প্রতি চট্টগ্রামের পটিয়ায় ৬০ হাজার ইয়াবাসহ ডিএনসির সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। মামুন চট্টগ্রাম ‘খ’ সার্কেলের পটিয়ার মুজাফফরাবাদ কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। ৮ নভেম্বরের ঘটনার পর আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১০ নভেম্বর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সূত্র বলছে, তিনি মাদক কারবারিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছিলেন। পেশাগত পরিচয় কাজে লাগিয়ে, ডিএনসির জ্যাকেট, ক্যাপ ও ওয়াকিটকি ব্যবহার করে তিনি মাদক বহনে কারবারিদের সহায়তা করতেন।
পটিয়া থানার ওসি মো. নুরুজ্জামান জানান, চট্টগ্রামের পটিয়ায় ৬০ হাজার ইয়াবা জড়িত ঘটনায় র্যাব মামলা করেছে। মামলায় ডিএনসির এএসআই আবদুল্লাহ আল মামুনকে তিন দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এখনও মামলার তদন্ত চলমান। পটিয়া থানার এসআই প্রদীপ কুমার দে বলেন, তদন্তে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার পাঁচজনের মধ্যে একজন ডিএনসির হওয়ায় বিষয়টি লিখিতভাবে সংস্থাকে জানানো হয়েছে।
এই ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় মাদকসহ আটক দুই ব্যক্তিকে টাকা দিয়ে ছাড়া দেওয়ার অভিযোগে তোলপাড় হয়েছিল। ২১ অক্টোবর ভোরে ডিএনসি মানিকগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের এসআই রফিকুল ইসলাম ও ১০ সদস্যের একটি দল সাটুরিয়ার ধানকোড়া ইউনিয়নের তারাবাড়ি এলাকায় অভিযান চালায়। তখন দুইজনকে আটক করা হয়। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাদের ছাড়া দেওয়া হয়। ক্ষুব্ধ হয়ে লোকজন অভিযানের দলকে ৯ ঘণ্টা আটকে রাখে। চাপের মুখে এসআই রফিকুল টাকা ফিরিয়ে দেন। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে ও কর্মকর্তাদের উদ্ধার করে। পরে ডিএনসি প্রধান কার্যালয় এসআই রফিকুলকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়।
সাটুরিয়া থানার ওসি আল-মামুন বলেন, “এটি আমার যোগ দেওয়ার আগের ঘটনা। অভিযানের সময় ডিএনসি কর্মকর্তারা আটকা পড়েছিলেন। পুলিশ তাদের উদ্ধার করেছে। অভিযানের সময় গ্রেপ্তার আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে ডিএনসির পক্ষ থেকে মামলা হয়েছে। তবে কর্মকর্তাদের আটকে রাখার বিষয়ে মামলা হয়নি।”
এর আগে জুলাইয়ে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে মাদকবিরোধী অভিযানে সাড়ে আট লাখ টাকা লুটের ঘটনায় ডিএনসি জেলা কার্যালয়ের তিন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তারা হলেন– পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম, উপপরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান ও সহকারী উপপরিদর্শক জিয়াউর রহমান।
ভুঞাপুর পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ছালেহা বেগম অভিযোগ করেন, ১৮ জুন সকালে তার বাড়িতে অভিযান চালায় ডিএনসির দল। কোনো মাদক না পেলেও গাড়ির তেল খরচ বাবদ ২০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর আবারও ঘরে ঢুকে দীর্ঘ তল্লাশি চালানো হয়। পরে একটি ঘরের আলমারি থেকে ছয় লাখ ৬৬ হাজার এবং আরেক ঘরের আলমারি থেকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা নেওয়া হয়।
ডিএনসি টাঙ্গাইল জেলা কার্যালয়ের তৎকালীন উপপরিচালক আবুল হোসেন বলেন, “তদন্ত করে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলাম। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। পরে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।” চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়ার চার মাস পর ডিএনসির সিপাহি হাসিবুল ইসলামকে নথিপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে পুনর্বহালের অভিযোগ উঠেছে। সূত্র বলছে, তিনি কুড়িগ্রাম জেলা কার্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় ২০২৪ সালের মে মাসে অনুমতি ছাড়া প্রায় এক মাস অনুপস্থিত ছিলেন। ৯ জুন স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এই অব্যাহতি প্রধান কার্যালয়ে পাঠায়নি।
প্রায় চার মাস পর ৩০ সেপ্টেম্বর হাসিবুল আবার যোগ দেওয়ার আবেদন করেন। তখন কুড়িগ্রাম কার্যালয়ের নথিপত্র ও স্মারক নম্বর জালিয়াতি করে তাকে পুনর্বহাল করা হয় বলে অভিযোগ। এই প্রসঙ্গে আলী আসলাম হোসেন বলেন, “ঘটনাটি সিপাহি ও সহকারী পরিচালকের বাগবিতণ্ডার ফল। সিপাহি চাকরি ছাড়ার আবেদন করেন, এক দিন পর ফের যোগ দেওয়ার আবেদন জানালে সহকারী পরিচালক তাঁকে অনুমতি দেননি। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে তাকে পুনর্বহাল করা হয়েছে।” কুড়িগ্রাম কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নাজির উল্লাহ বলেন, “আমি মন্তব্য করব না। তবে কোনো কর্মীকে চার মাস হাজিরা থেকে বিরত রাখার এখতিয়ার আমার নেই।”
ঠাকুরগাঁওয়ে ২৯ মে ডিএনসি জেলা কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে বিপুল মাদক ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। সংশ্লিষ্ট পরিদর্শক ফরহাদ আকন্দ দাবি করেন, জব্দ মাদকের কিছু আলামত বিভিন্ন মামলার। কিন্তু প্রমাণ দেখাতে পারেননি। পরে তাকে ওএসডি করে ঢাকা অফিসে সংযুক্ত করা হয়। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিরীহ লোকজনকে ফাঁসিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে।
৯ মার্চ কক্সবাজারে এক সাংবাদিককে মাদক মামলায় ফাঁসানোর ঘটনায় সহকারী পরিচালক এ কে এম দিদারুল আলমকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। একই মাসে পিরোজপুর জেলা কার্যালয়ের তৎকালীন সহকারী পরিচালক বাবুল সরকারের নারীসহ মাদক সেবনের ছবি ভাইরাল হয়। পৃথক ঘটনায় ২৪ জুলাই তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।

