বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অভিবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের অবদান অপরিসীম। বিদেশে কর্মরত হাজার হাজার বাংলাদেশি দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন, যা দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৭৬টি দেশে প্রায় ১ কোটি ৪৯ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মী আছেন। তবে এই সংখ্যার সঠিকতা নিয়ে কিছুটা প্রশ্নও রয়েছে।
সাধারণত যারা বিদেশে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজ করেন এবং পরবর্তীতে দেশে ফিরে আসেন, তাদেরই অভিবাসী হিসেবে ধরা হয়। সেই মানদণ্ডে, বাংলাদেশের বিভিন্ন দেশে কর্মরত অভিবাসীর সংখ্যা এক কোটির সামান্য বেশি। বিশ্বে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একাধিকবার শীর্ষে থেকেছে। সম্প্রতি টানা তিন বছর ধরে প্রতি বছর ১০ লাখের বেশি শ্রমিক বিদেশে পাঠানো হয়েছে, যা বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
২০২৪ সালে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮৫৬ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন। তবে বেশিরভাগ কর্মী (৯৫ শতাংশ) মাত্র পাঁচটি দেশে গিয়েছেন—সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। নতুন বাজার তৈরি না হওয়া এবং পুরনো বাজারে দুর্নীতির কারণে সমস্যাগুলি ক্রমেই বাড়ছে।
২০২৫ সালের শুরুতে জনশক্তি রপ্তানি কমেছে। জানুয়ারিতে ৯৭,৮৭৩ জন কর্মী বিদেশে গেছেন, কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬২,৪৪২ জনে, যা প্রায় ২০ শতাংশ হ্রাস। বিশেষত তিনটি বড় শ্রমবাজার—মালয়েশিয়া, ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত—বিভিন্ন কারণে বন্ধ হওয়ায় এই হ্রাস ঘটেছে। এছাড়া সৌদি আরব, কাতার ও বাহরাইনের বাজারেও নিয়োগ কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার মূল কারণ হলো দুর্নীতি। ২০২৩ সালে ৩.৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সালের জুন থেকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ৩ হাজার ৩৩১ প্রার্থীর কাছ থেকে সরকারি নির্ধারিত টাকার বেশি অর্থ আদায় এবং পাচারের অভিযোগে ৬টি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক ও কর্মকর্তাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এর আগে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে আরও ৩১ জনের বিরুদ্ধে ১৩টি পৃথক মামলা করা হয়, যাদের মাধ্যমে সিন্ডিকেট গঠন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, মালয়েশিয়ায় পাঠানোর জন্য প্রার্থীকে সরকার নির্ধারিত ৭৮,৯৯০ টাকা ছাড়াও পাঁচ গুণ পর্যন্ত অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়েছে। এসব অসাধু এজেন্টরা বিএমইটি ও বায়রার নিয়ম ভেঙে অবৈধভাবে শ্রমিক নিয়োগের কাজ চালিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে হাজার হাজার যোগ্য প্রার্থীও সময়মতো মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি।
সরকার বিশেষ জি-টু-জি ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রমিক পাঠানোর চেষ্টা করছে, তবে সিন্ডিকেটের কারণে সমস্যা এখনও টিকে আছে। এক শ্রমবাজার বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন, “সিন্ডিকেট ছাড়া শ্রমবাজার চালু করা না হলে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না।”
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আবার চালু করার জন্য বাংলাদেশি কর্মকর্তারা দেশটির সরকারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় নির্ধারণ হবে, কোন খাতে কতজন শ্রমিক নেওয়া হবে। তবে সিন্ডিকেট এবং দালালদের দৌরাত্ম্য এখনও প্রবাসী কর্মীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
অতএব, প্রবাসী কর্মীদের জন্য নিরাপদ, স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু শ্রমবাজার নিশ্চিত করা না হলে রেমিট্যান্সের অগ্রগতি এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ঝুঁকির মুখে থাকবে। সমস্যার মূল হলো দুর্নীতি এবং সিন্ডিকেট, যা সমাধান না হলে হাজারো প্রবাসীর স্বপ্ন এবং দেশের অর্থনীতি উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

