দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা “ভারতের মুক্তো” বা “ভারতের নেকলেসের মুক্তো” নামে খ্যাত। এই নামটি তার অবস্থান ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে দেওয়া হয়েছে। কারণ, এর মানচিত্র ভারত মহাসাগরে অবস্থিত এক ফোঁটা জলের কণার মতো এবং এই দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোমুগ্ধকর। যদিও এর অর্থনৈতিক অবস্থা এখন আর এমন মুগ্ধকর নয়। দক্ষিণ এশিয়ার একসময়ের সুস্থির অর্থনীতির উদাহরণ হিসেবে পরিচিত এই দেশটি বর্তমানে এক গভীর অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। দেশটির বিগত সরকারের নীতিগত ভুল, ঋণগ্রহণের অতিরিক্ত প্রবণতা এবং বৈশ্বিক প্রভাবের কারণে এই সংকট ঘনীভূত হয়েছে। আজকের শ্রীলংকার এই পরিস্থিতি কেবল তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সমস্যাই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের জন্য একটি সতর্কবার্তাও বটে।
দুই বছর আগের সেই চরম অস্থিতিশীল অবস্থান থেকে শ্রীলংকা এখন অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির হারও নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ পাওয়ার পর বৈদেশিক ঋণ সংকট মোকাবিলার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেড়েছে। গত জুন মাসে শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি নেমে আসে ২ দশমিক ৪০ শতাংশে, যেখানে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এটি ছিল ৬৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, যা দেশটির অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল।
শ্রীলংকার অর্থনীতির সংকটের পেছনের কারণ:
শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকটের শুরু ২০১৯ সালে যখন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে ক্ষমতায় আসার পরপরই বড় ধরনের কর হ্রাসের সিদ্ধান্ত নেন। এই কর হ্রাসে ব্যক্তিগত ও কর্পোরেট করের হার কমানো হয়, যা দেশের আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়। ফলস্বরূপ, সরকারের রাজস্ব ঘাটতি বাড়তে থাকে এবং বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। এই নীতিগত ভুলের কারণেই শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকট দ্রুত তীব্র হয়ে ওঠে। শ্রীলঙ্কার পূর্ববর্তী সরকারের আরেকটি বড় ভুল ছিল উন্নয়নের নামে অতিরিক্ত বিদেশি ঋণ গ্রহণ। বিশেষ করে চীনের কাছ থেকে বিশাল ঋণ নেওয়া হয়, যা অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। তবে এই প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগই অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি আনতে ব্যর্থ হয়। ফলে শ্রীলংকা ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়ে। ২০২১ সালের শেষ দিকে দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপিকে ছাড়িয়ে যায়, যা দেশের অর্থনীতিতে গভীর সংকটের সৃষ্টি করে।
বৈদেশিক ঋণের চাপে শ্রীলংকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। পর্যটন আয় এবং রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে আমদানি পণ্যের জন্য পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ ছিল না। এর ফলে দেশটিতে জ্বালানি, খাদ্য এবং ঔষধের সংকট দেখা দেয়, যা জনগণের দৈনন্দিন জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্প একসময় দেশের অন্যতম প্রধান বৈদেশিক মুদ্রার উৎস ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের ইস্টার সানডে বোমা হামলার পর থেকেই এই খাতটি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। সেই আঘাত কাটতে না কাটতেই ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারী আঘাত হানে, যা পর্যটন খাতকে প্রায় পুরোপুরি স্তব্ধ করে দেয়। পর্যটকদের আগমন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ এই পথটিও বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে দেশটি ভয়াবহ বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়েছে, যা শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
আবার , ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে সরকার একটি নতুন পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয়। দেশব্যাপী জৈব কৃষির দিকে রূপান্তরের উদ্দেশ্যে কেমিক্যাল সার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে। কিন্তু এই রূপান্তরের জন্য দেশের কৃষি ব্যবস্থা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সারের অভাবে কৃষির উৎপাদন, বিশেষত: চাল উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এর ফলে খাদ্য সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করে। পাশাপাশি, খাদ্য আমদানির প্রয়োজনে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ আরও বেড়ে যায়, যা দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
বর্তমান পরিস্থিতি ও সরকারের পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা:
শ্রীলঙ্কা ২০২২ সালে আইএমএফ-এর কাছে একটি অর্থনৈতিক সহায়তা প্যাকেজের জন্য আবেদন জানায়। এর পর আইএমএফ দেশটিকে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি ঋণ প্যাকেজ অনুমোদন করে। এই অর্থায়ন শ্রীলঙ্কার আর্থিক অবস্থা উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনরুদ্ধার এবং জরুরি পণ্য আমদানিতে সহায়তা প্রদান করেছে। তবে আইএমএফ এই ঋণের বিনিময়ে কিছু কঠোর শর্ত আরোপ করেছিল, যার মধ্যে কর বৃদ্ধি, ভর্তুকি হ্রাস এবং সরকারি খাতের সংস্কার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। যা শ্রীলঙ্কার জন্য পরিস্থিতি কারো কঠিন করেছে।
শ্রীলংকার বৃহত্তর ঋণদাতা হিসেবে চীন তাদের ঋণের বোঝা লাঘব করতে পুনঃতফসিলের প্রস্তাব দিয়েছে। তবে, শ্রীলংকা চীনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়ায় দেশটি রাজনৈতিকভাবে চাপের মুখে পড়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, চীনের প্রতি এই নির্ভরশীলতা ভবিষ্যতে শ্রীলংকার অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। গোতাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের পর নতুন সরকার কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যকর করার চেষ্টা করছে। বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা এখনও পুরোপুরি দূর হয়নি। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারকে কঠোর ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নিতে হবে।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে নেওয়া অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর পুনঃমূল্যায়ন। অনেক প্রকল্প ছিল আর্থিক দিক থেকে অপ্রয়োজনীয়। যা দেশের ঋণের বোঝা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমান সরকার এখন এসব প্রকল্পের কার্যকারিতা গভীরভাবে পর্যালোচনা করছে এবং নতুন উন্নয়ন প্রকল্প শুরু করার আগে তাদের প্রয়োজনীয়তা ও সুফলগুলো নিশ্চিত করতে কাজ করছে।
শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা:
শ্রীলংকার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বৈদেশিক ঋণের বোঝা কমানো এবং বাজেট ঘাটতি পূরণ করা। এজন্য সরকারকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে হবে, করনীতি সংস্কার করতে হবে এবং অপচয় কমাতে হবে। এর পাশাপাশি পর্যটন খাত পুনরুদ্ধার এবং কৃষি খাতের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজন। শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অনেকাংশে নির্ভর করছে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। যদি সরকার সঠিকভাবে নীতি সংস্কার করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন করতে পারে, তবে দেশটি এই সংকট থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে পারবে।
মূলত: শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকট একটি বহুমুখী সমস্যার ফল। যার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতির ব্যর্থতা। বিগত সরকারের ভুল নীতির কারণে সেই দেশটিতে আজকের এই সংকট দেখা দিয়েছে। তবে, বর্তমান সরকারের সঠিক নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে শ্রীলংকা পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে এনে শ্রীলংকা আবারো অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল একটি দেশ হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের শ্রীলংকা থেকে শিক্ষার বিষয় এই যে, একটি সমৃদ্ধ দেশও যেকোনো সময় ভুল সিদ্ধান্ত ও অপরিকল্পিত পরিকল্পনার কারণে সংকটের মুখে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরো সতর্কতা অবলম্বন করে আগামীর পথ চলতে হবে।