টানা প্রায় তিন বছর ধরে বাংলাদেশে সাধারণ ভোক্তারা মূল্যস্ফীতির ভয়াবহতার মুখোমুখি। চড়া দামের এই চাপ ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষের জন্য। বিগত সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে নেয়া ভুল অর্থনৈতিক নীতি, বড় অংকের টাকা পাচার এবং মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলেছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন নতুন সরকার দায়িত্ব নিলে জনগণ আশাবাদী হয়েছিল যে দুর্নীতি কমবে, টাকার পাচার বন্ধ হবে এবং নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা হলেও সহনীয় পর্যায়ে আসবে। কিন্তু নতুন সরকারের তিন মাস পূর্ণ হওয়ার পরও পণ্যমূল্য হ্রাসের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; বরং তা উল্টো বেড়েছে। শুধু ব্যবস্থা কিছুটা পরিবর্তন করে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে কিন্তু তা এখনও ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে বেড়েছে এবং এ সময়ে ভোক্তার মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ওই সময় মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.১৭ শতাংশ, যা মজুরি বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে যায়। ২০২২ সালের আগস্টে বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশ অতিক্রম করে এবং এ ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। মূল্যস্ফীতির এই প্রবণতার ফলে ভোক্তারা সঞ্চয় ভেঙেছে এবং ঋণগ্রস্ত হয়েছে; জীবনযাত্রার মানও কমে গেছে।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে এবং বিগত সরকারের ছাপানো টাকার ঋণ পরিশোধ করে মুদ্রার চাপ কিছুটা কমানোর চেষ্টা করছে। তবে ডলারের ঊর্ধ্বগতির উপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ এলেও এখনও পণ্যমূল্য স্থিতিশীল হয়নি। বিশেষত, নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে চড়া দাম রয়ে গেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে তা বেড়েছেও। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে উঠে আসছে যে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে বাজারে সক্রিয় শক্তিশালী সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হচ্ছে। বিগত সরকারের একাধিক মন্ত্রী এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমান সরকার সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বললেও চাঁদাবাজির মাত্রা এখনও কমেনি। বরং রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের পর চাঁদাবাজির দায়িত্ব পাল্টেছে কিন্তু তা বন্ধ হয়নি।
নিত্যপণ্যের সরবরাহ কম হওয়ার কারণে বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাধা দিচ্ছে। এ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মতামত হলো, সরকারের দ্রুত পদক্ষেপের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা দরকার, যাতে বাজারে আস্থা তৈরি হয় এবং বিনিয়োগ বাড়ে। এজন্য ব্যবসা-বাণিজ্যে একটি স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে জানিয়েছে যে, চাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক মওকুফ করা হয়েছে। এছাড়াও, ডলারের দাম কমানো এবং এলসি মার্জিন কমানো হয়েছে। কিন্তু সরকারের নেয়া এসব পদক্ষেপের সুফল এখনও ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না বরং ব্যবসায়ীরা এর সুবিধা ভোগ করছে। প্রশাসনের যথাযথ নজরদারি না থাকার কারণেই এর কার্যকর ফল মিলছে না বলে অনেকে মনে করেন।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নতুন সরকারের কাছ থেকে ভোক্তারা নিত্যপণ্যের মূল্য হ্রাসের আশায় ছিল। সরবরাহ বাড়াতে শুল্ক ছাড় দেয়া এবং প্রশাসনিক তদারকি বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাজারে অসাধু কারসাজি রয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।
টিসিবি’র তথ্য অনুযায়ী, সরকার পতনের আগে আগস্ট মাসে প্রতিকেজি চাল ৭৮ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে তা বেড়ে ৮০ টাকায় পৌঁছেছে। একইভাবে পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, ময়দা, আলুসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। এমনকি খুচরা বাজারে ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস এবং ডিমের দামও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া শীত মৌসুমের কাছাকাছি সময়ে এসে সবজিসহ অন্যান্য মৌসুমি পণ্যের সরবরাহ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা পণ্যমূল্য হ্রাসে কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে।
সরকারের প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও দেশের বাজারে তার প্রভাব এখনও সুস্পষ্ট নয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, সামনের দিনগুলোতে একটি স্থিতিশীল অর্থনীতি নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও কার্যকর এবং আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যা ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতার উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।