বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের ব্যাংকিং খাতে সুদের আয় বাড়ানোর বিভিন্ন উদ্যোগ দেখা গেলেও খরচের লাগাম টানা যাচ্ছে না। যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে এক নতুন সংকট তৈরি করছে। কয়েক বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রকোপে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী সবাই চাপে রয়েছেন। মূল্যস্ফীতি কমাতে অর্থ সরবরাহে কঠোরতা আরোপের নীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যার অংশ হিসেবে এ বছর সুদহার চারবার বাড়ানো হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ায় সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের ছোট, মাঝারি এবং বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। বাজারের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা সত্ত্বেও এই পদক্ষেপে ঋণগ্রহণে আগ্রহ কমছে, ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে ।
মাত্র এক বছর আগেও ব্যাংক ঋণের সুদহার ছিল এক ডিজিটের মধ্যে অর্থাৎ ৯ শতাংশের মধ্যে। গত জুলাই মাসে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এই সীমা প্রত্যাহার করে ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব কাঠামোর আলোকে সুদ হার নির্ধারণের নির্দেশনা প্রদান করে। এ নির্দেশনা দেওয়ার ফলে আজ সুদহার বেড়ে কোনো কোনো ব্যাংকে ১৪-১৫ শতাংশ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে- ২০২০ সালের জুলাই মাসে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ছিল ৭.৭৯ শতাংশ, যা চলতি বছরের জুলাইয়ে দাঁড়িয়েছে ১১.৫৭ শতাংশে।
সাম্প্রতিক সময়ে সুদহারের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি ব্যবসায়ীদের সামনে বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন যে, বিগত সরকারের আমলে একাধিকবার গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি ও অন্যান্য খরচের কারণে ব্যবসার ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের মূল্য বিশেষভাবে না বাড়লেও অভ্যন্তরীণ খরচ দ্রুত বেড়েছে, যা রপ্তানিমুখী শিল্পকে একপ্রকার চাপে রেখেছে। সুদহার এভাবে বাড়তে থাকলে ঋণ পরিশোধে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে এবং অনেকে নতুন করে ঋণ খেলাপির ঝুঁকিতে পড়বেন। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া সমগ্র অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ এটি ব্যাংক খাতকে দুর্বল করবে এবং ব্যবসায়ীরা পুনরায় ঋণ পেতে আরো বেশি সমস্যায় পড়বেন।
অতএব, স্থিতিশীল অর্থনীতির স্বার্থে সুদহার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসায় খরচ কমানোর উপায় খুঁজে বের করা একান্ত প্রয়োজন। বিদ্যুত, গ্যাস এবং শ্রম খাতে সাশ্রয়ী ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সুদহার স্থিতিশীল রাখা হলে ব্যবসায়ীরা তাদের উৎপাদনশীলতাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবেন। এর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীল ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।
২০২৩–২৪ অর্থবছরে দেশের বেসরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ দুই বছর আগেই, ২০২১-২২ অর্থবছরে এই হার ছিল প্রায় দ্বিগুণ অর্থাৎ ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। এমন প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার বিষয়টি স্পষ্টতই অর্থনীতিতে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন উচ্চ সুদহার, ক্রমবর্ধমান উৎপাদন ব্যয় এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অস্থিতিশীলতার মতো নানা কারণ এ মন্দার জন্য দায়ী।
বিশেষজ্ঞদের মতে- বিনিয়োগের এই নিম্নমুখী প্রবণতা অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। কম বিনিয়োগের ফলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যা বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ করার আশঙ্কা তৈরি করছে। এর পাশাপাশি, বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে গেলে আগামী বছরে আরও বেশি ব্যবসায়িক অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে। অতএব স্থিতিশীল বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সুদহার কমানো, খরচ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আনা এবং জ্বালানি অবকাঠামোকে আরও মজবুত করা প্রয়োজন। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি হলে দেশের অর্থনীতি পুনরায় গতিশীলতা পাবে, যা বাংলাদেশকে আরও শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থানে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য খোলা ঋণপত্রের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৩ দশমিক ৭১ শতাংশ কম। একইসঙ্গে প্রাথমিক কাঁচামালের আমদানিও কমেছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান ইঙ্গিত করছে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি বিপর্যস্ত চিত্র, যা ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির ওপর চাপ ফেলতে পারে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, উচ্চ সুদহার এবং বাজারে চাহিদার অনিশ্চয়তা এই আমদানি হ্রাসের মূল কারণ। মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের আমদানি কমে গেলে উৎপাদনশীল খাতে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। যা উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অচলাবস্থা তৈরি করতে পারে। দেশীয় উৎপাদন কমে গেলে পণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতি তৈরি হবে, যা সাধারণ ভোক্তাদের জন্যও চাপের কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বাধিক। এ পরিসংখ্যান আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য একটি গুরুতর সংকেত। তবে সুখবর হলো সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে নেমে এসেছে। যদিও এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন, তবে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ফেলছে।
বাজারের অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য জীবনযাপন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। দ্রব্যমূল্যের এই অস্থিরতা সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। সরকার এবং নীতি নির্ধারকদের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। যাতে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্যগুলোর দাম স্থিতিশীল করা যায় এবং জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ কমানো সম্ভব হয়।
তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সরকারের পতনের পর থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যয় সংকোচন নীতির আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। এই অবস্থায় চলতি অর্থবছরের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৮৫ হাজার কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারের এই পদক্ষেপ দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে, আমাদের দেশ একটি সংকটময় অবস্থার মুখোমুখি। সম্প্রতি সুদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে ব্যাংকিং খাতে আয়ের পরিমাণ বেড়েছে। দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পথে থাকা ব্যাংকগুলো আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের উপর খরচের চাপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক কাঠামোগত সংস্কার এবং ব্যাংকিং খাতে সুদের নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা। এজন্য নিম্নের পদক্ষেপগুলি জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা প্রয়োজন।
প্রথমতঃ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদের হার নির্ধারণে সহনশীলতা আনতে হবে। ঋণগ্রহণকারীরা যেন সহজে ঋণ নিতে পারেন, সেজন্য সুদের হার এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যা তাদের জন্য সহায়ক। বর্তমানে উচ্চ সুদের হার অনেক ব্যবসায়ীকে ঋণ গ্রহণে সংকুচিত করে তুলছে, যা দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করছে।
দ্বিতীয়তঃ সরকারকে বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করলে তারা ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারবেন, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং অর্থনীতির শক্তি বাড়াবে। গবেষণা অনুযায়ী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলি দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ২৫% অবদান রাখে। তাই তাদের উন্নয়ন দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো, পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করা এবং অপরিকল্পিত মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সুদে আয়ের প্রবৃদ্ধি বর্তমানে অনেকের জন্য সাময়িক স্বস্তি এনে দিলেও প্রকৃতপক্ষে এটি খরচের চাপ মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। অর্থনীতির গতিশীলতার সাথে খাপ খাইয়ে সামগ্রিক ব্যয় বৃদ্ধি ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রতিটি পরিবারের মাসিক বাজেটে অবিচ্ছিন্ন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ফলে সুদের মাধ্যমে আয় বাড়লেও, সে আয়ের সিংহভাগই খরচে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। যা ব্যক্তিগত সঞ্চয় ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় আঘাত হানছে। এই সংকট মোকাবেলায় কার্যকর অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন, পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং সুদের হারের সামঞ্জস্য রেখে কার্যকর ঋণনীতি এবং ব্যাংকিং খাতে সরকারের পর্যাপ্ত সহায়তা রাখার মাধ্যমে একটি ভারসাম্যমূলক অর্থনৈতিক কাঠামো নিশ্চিত করা জরুরি।