বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে একটি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। গত অক্টোবর-ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের বিপরীতে ৯ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা আদায় করেছে যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদায়ের পরিমাণ। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলোই সবচেয়ে বেশি—৮ হাজার ২৬ কোটি টাকা যা মোট আদায়ের প্রায় ৮২ শতাংশ।
এই সাফল্যের পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকি এবং কিছু ব্যাংকের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ঋণ আদায়ে জোরদার প্রচেষ্টা রয়েছে যা সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ব্যাংকাররা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের জন্য কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে না পারলে তাদের টিকে থাকা সম্ভব হবে না। আগের মতো নিয়মিত ঋণ পরিশোধ দেখানোর সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া বর্তমানে চলতি মূলধন ঋণের সীমা বাড়িয়ে নিয়মিত দেখানোর পথও বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো এবং ব্যাংকগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ঋণ আদায় প্রক্রিয়া কঠোরভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ তিন মাসে ৯ হাজার ৭৯২ কোটি টাকার আদায় হওয়া একটি নতুন মাইলফলক। এর আগের সর্বোচ্চ আদায় ছিল ৭ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে হয়েছিল। ২০২২ সালের শেষ তিন মাসে আদায় হয়েছিল ৫ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, ২০২১ সালে ছিল ২ হাজার ৬৭২ কোটি এবং ২০২০ সালে ২ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে এ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ থেকে মোট ২৪ হাজার ৯১ কোটি টাকা আদায় হয়েছে যা স্পষ্টভাবে গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে আরো কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেছে। ব্যাংকগুলোকে ঋণের শ্রেণী অনুযায়ী তথ্য প্রকাশ করতে হচ্ছে। অনেক ব্যাংক নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ঋণ আদায়কে জোরদার করেছে। তবে যারা পুনঃতপশিল করতে চান তাদের সহায়তা করা হবে যদি তারা নির্ধারিত ডাউন পেমেন্ট প্রদান করেন এবং সব নিয়ম মেনে চলে।
বিগত সরকারের সময়ে ঋণ আদায়ের চেয়ে ঋণ কম দেখানোর নানা কৌশল প্রয়োগ করা হতো। বিশেষত, ২০১৪ সালের ‘রাতের ভোট’-এর পর ব্যবসায়ীদের খুশি রাখতে এসব কৌশল ব্যাপকভাবে চালু হয়। তবে ২০২০ সালের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণকে নিয়মিত করার ক্ষেত্রে কিছু শিথিলতা দিলেও, বর্তমান সরকার পতনের পর সেই সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে, খেলাপি ঋণের আসল চিত্র সামনে এসেছে এবং তাতে ঋণ পরিশোধ না করা ব্যক্তিদের সংখ্যাও দ্রুত বেড়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। এক বছর আগের তুলনায় এই ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ১৩১ কোটি টাকা।
এক বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ আদায় সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, তিনি ২১ বছর ধরে ব্যাংকিং সেক্টরে কাজ করছেন এবং এতো কঠোর ঋণ আদায়ের চাপ আগে কখনও অনুভব করেননি। ব্যাংকারদের মধ্যে এক কঠোর বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে যে ঋণ আদায় না করলে চাকরি থাকবে না। বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকগুলোতে এই চাপ বেশি। ব্যাংকগুলোর বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয় বছরের শেষ প্রান্তিকের পরিস্থিতির ভিত্তিতে এবং ওই সময়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ব্যাংকগুলো তাদের লভ্যাংশ এবং কর্মীদের বোনাস নির্ধারণ করে। বর্তমানে প্রকৃত ঋণ আদায় ছাড়া কোনো ব্যাংক খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে পারছে না এবং প্রভিশন ঘাটতি রেখে লভ্যাংশও দিতে পারছে না।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ২০২২ সালের ১৮ জুলাই ঋণ পুনঃতপশিলের নীতিমালা শিথিল করেন। ওই সময় থেকেই ঋণ পুনঃতপশিলের মাধ্যমে ২০২২ ও ২০২৩ সালে মোট ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৪১ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতপশিল করা হয়। এর ফলে লুকিয়ে রাখা ঋণগুলো এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে যা ব্যাংকিং খাতে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
এভাবে কঠোর নীতি গ্রহণ, ঋণ আদায়কে জোরদার করা এবং লুকানো ঋণের বাস্তবতা সামনে আসার ফলে খেলাপি ঋণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু চাপ রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই কঠোর পদক্ষেপগুলো ব্যাংকিং খাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা বয়ে আনতে পারে।


