যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ নামে একটি বাণিজ্য নীতি চালু করেছে যার আওতায় নির্দিষ্ট কিছু দেশের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মার্কিন প্রশাসনের দাবি—এই নীতির মাধ্যমে তারা বাণিজ্যে সমতা আনতে চায়। যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে বেশি শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রও সেই দেশের পণ্যে সমপরিমাণ শুল্ক বসাবে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই নীতির কার্যকারিতা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ তেমনি এটি বিশ্ব বাণিজ্যে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করতে পারে।
কী এই ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’?
‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ অর্থাৎ ‘পাল্টা শুল্ক’—এর ধারণা সহজ একটি দেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক নেয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রও সেই দেশের পণ্যে সমপরিমাণ শুল্ক আরোপ করবে। মার্কিন প্রশাসন বলছে, তাদের বহু বছর ধরে বাণিজ্য ঘাটতি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশগুলো উচ্চ শুল্ক আরোপ করে কিন্তু মার্কিন বাজারে তাদের পণ্য ঢুকছে কম শুল্কে বা শুল্কমুক্তভাবে। তাই এই বৈষম্য দূর করতেই নেওয়া হয়েছে নতুন পদক্ষেপ।
এই নীতির প্রবর্তক হিসেবে কাজ করছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যিনি ২০২৫ সালের নির্বাচনী প্রচারে ফের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ ট্রাম্পের যুক্তি হলো—যে দেশ আমেরিকাকে ব্যবসায় ঠকায় আমেরিকা তাকে ব্যবসায় একইভাবে প্রতিশোধ জানাবে।
বাংলাদেশ কোন অবস্থানে?
হোয়াইট হাউস প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে গড়ে ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যে ৩৭ শতাংশ ‘রিসিপ্রোকাল’ শুল্ক বসাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তবে এটি মোট শুল্ক নয়—এই ৩৭ শতাংশ যুক্ত হবে বিদ্যমান শুল্কের সঙ্গে। বর্তমানে বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে প্রায় ১৫ শতাংশ শুল্ক প্রযোজ্য ফলে নতুন শুল্ক কার্যকর হলে মোট হার দাঁড়াবে প্রায় ৫২ শতাংশ।
তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা যুক্তরাষ্ট্রের ৭৪ শতাংশ শুল্ক দাবিকে বাস্তবভিত্তিহীন বলছেন। তাদের মতে, বাংলাদেশ গড়ে ৭-৮ শতাংশের বেশি শুল্ক নেয় না এবং বেশ কিছু আমদানিপণ্য যেমন তুলা, গম, জ্বালানি তেল ইত্যাদির ওপর শুল্ক প্রায় শূন্য।
বাংলাদেশের জন্য এর প্রভাব কী?
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়তে পারে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম বড় পোশাক বাজার। গত বছর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮৪০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে যার মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি পোশাক। যুক্তরাষ্ট্র নতুন শুল্ক বসালে এই পণ্যের দাম বেড়ে যাবে ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা অন্য সস্তা উৎসে চলে যেতে পারেন—যেমন কেনিয়া, মিশর, ভিয়েতনাম বা মেক্সিকো।
পাশাপাশি বাংলাদেশ যে তুলা দিয়ে পোশাক তৈরি করে তার বড় অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকেই। অর্থাৎ বাংলাদেশের তৈরি পণ্যে মার্কিন উপাদান থাকলেও সেই পণ্যে শুল্ক বসানো হবে—যা অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিসঙ্গত নয় বলে বিশ্লেষকেরা বলছেন।
বিশ্ববাণিজ্যে প্রভাব ও অন্য দেশের প্রতিক্রিয়া
এই নীতির আওতায় বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, ভারত, ব্রাজিল, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশের পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক বসানো হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীন ইতিমধ্যে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। ফলে বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কাও বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নীতির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়তে পারে, সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে এবং বহু দেশের রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে।
বাংলাদেশ কী করতে পারে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের উচিত হবে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক—উভয় কৌশল গ্রহণ করা।
১. দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানো উচিত যে বাংলাদেশের শুল্ক কাঠামো প্রকৃতপক্ষে কতটা।
২. যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত তুলা, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য উপাদানের তথ্য তুলে ধরে যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে বাংলাদেশ আসলে যুক্তরাষ্ট্রেরই উপাদান ব্যবহার করে তাদের বাজারে পণ্য সরবরাহ করছে।
৩. অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আলোচনায় যাওয়া যেতে পারে, যেন আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করা যায়।
৪. বিকল্প বাজার খোঁজা এবং রপ্তানির বহুমুখীকরণে কাজ করা এখন সময়ের দাবি।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ নীতি একটি রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক কৌশল—যার মূল লক্ষ্য ট্রাম্প প্রশাসনের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ও আমেরিকার বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি কমানো। তবে এর বাস্তবায়নে বিশ্ব অর্থনীতি চাপে পড়তে পারে, আর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বড় ঝুঁকিতে পড়বে। তাই নীতির অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করে কৌশলগত প্রস্তুতি নেওয়া এখন জরুরি।
ট্রাম্প প্রশাসনের যুক্তি, যেসব দেশ মার্কিন পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছিল তাদের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র এখন একই ধরনের শুল্ক আরোপ করছে। হোয়াইট হাউস প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশ মার্কিন পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে। এরই প্রতিক্রিয়ায় এখন থেকে বাংলাদেশি পণ্যে ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করবে যুক্তরাষ্ট্র যা কার্যকর হবে ৯ এপ্রিল থেকে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে শুল্ক ছিল ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ নতুন শুল্ক আরোপের পর মোট শুল্ক দাঁড়াবে প্রায় ৫২ শতাংশ।
তবে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের এই ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তাদের মতে, বাংলাদেশ গড়ে ৭-৮ শতাংশের বেশি শুল্ক আরোপ করে না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র যে ৭৪ শতাংশ বলছে তার বাস্তব ভিত্তি নেই। তারা শুধু শুল্ক নয় এক্সচেঞ্জ রেট ও ট্রেড পলিসিও যুক্ত করেছে।” তিনি বলেন, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানিকৃত পণ্যের বড় অংশ ছিল তুলা যার ওপর শুল্ক ছিল শূন্য। এছাড়া লোহা ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর শুল্ক ছিল যথাক্রমে শূন্য ও ৩১ শতাংশ। সব মিলিয়ে গড়ে শুল্ক হয় ৭ থেকে ৮ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন শুল্ক নীতি বাংলাদেশের রপ্তানিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা। সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “৭৪ শতাংশের বিপরীতে ৩৭ শতাংশ শুল্ক কেন আরোপ করা হলো তা বুঝে পদক্ষেপ নিতে হবে।” তৈরি পোশাক খাতের নেতারাও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “ক্রেতারা বাংলাদেশে আসে সস্তা শ্রমের কারণে। যদি দাম বেড়ে যায় তাহলে তারা বিকল্প দেশে যাবে।” তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে কেনিয়া মিশর বা হন্ডুরাসের মতো দেশ, যেখানে শুল্ক কম এবং ভৌগলিকভাবে কাছাকাছি।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮৪০ কোটি ডলার, যার মধ্যে ৭৪০ কোটি ডলারই ছিল তৈরি পোশাক। বাকি ছিল ব্যাগ, প্লাস্টিক, জুতা ও কৃষিপণ্য। সস্তা শ্রমের কারণে এখানকার পোশাক সস্তা হলেও নতুন শুল্কের কারণে সেই পণ্যের দাম বেড়ে যাবে ফলে চাহিদা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “এই অতিরিক্ত শুল্কের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয় যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এতে তাদের পণ্য কেনার ক্ষমতা কমে যাবে, ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও মন্দা দেখা দিতে পারে।”
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি চিঠি পাঠিয়ে অতিরিক্ত শুল্ক আগামী তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ব্যাংকক থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব বলে আশাবাদী সরকার।
শফিকুল আলম আরো জানান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দ্রুততম সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক যৌক্তিককরণের জন্য বিকল্প খুঁজে বের করবে। ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লেখেন, “বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড পলিসিকে সমর্থন করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের তুলা যেন দ্রুত বাজারে আসে সে উদ্যোগও নিচ্ছে সরকার।”
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশের এখন দুই ধরনের প্রস্তুতি দরকার—স্বল্পমেয়াদে দরকষাকষি এবং দীর্ঘমেয়াদে নির্দিষ্ট বাজার নির্ভরতা কমানো। কারণ তৈরি পোশাক প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত তুলা বড় অংশে আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকেই। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “আমরা তাদের বলতে পারি, এই তুলা দিয়েই তৈরি পোশাক বানিয়ে তাদের বাজারে দিচ্ছি অর্থাৎ আমাদের রপ্তানি পণ্যে মার্কিন উপাদানও রয়েছে। তাই আমাদের জন্য কিছুটা ছাড় বিবেচনা করা যেতে পারে।”
বিশ্বজুড়ে একাধিক দেশের ওপর এই শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, ফলে অন্যান্য দেশগুলোর কৌশলও বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার পথে এগোচ্ছে। বাংলাদেশেরও প্রয়োজন বাস্তবতা বুঝে শক্ত অবস্থান নেওয়া।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এই শুল্ক নীতি টিকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তিনি বলেন, “যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারাও পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে যদি নীতিটি কার্যকর থাকে তাহলে বাংলাদেশকে জোরালো অবস্থানে যেতে হবে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “শুল্ক অবিলম্বে কার্যকর হতে যাচ্ছে। ফলে যে পণ্যগুলো এখনো জাহাজে রয়েছে বা কাস্টমস ক্লিয়ার হয়নি তার ওপরও এই নতুন শুল্ক প্রযোজ্য হবে। এমনকি উৎপাদনাধীন পণ্যও এই শুল্কের আওতায় পড়বে।”
সবশেষে অর্থনীতিবিদদের সুপারিশ—যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে কৌশলগত অবস্থান নিতে হবে বাংলাদেশকে। দরকার হলে অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সঙ্গে মিলে যৌথ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে আলোচনায় নামতে হবে যেন এই চাপ থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাওয়া যায়।

