গত এক সপ্তাহ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নানা অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও তার শুল্কনীতি সঠিক দাবি করে আসছিলেন। তার চাপিয়ে দেওয়া শুল্কনীতি বিশ্ববাজারে ব্যাপক অস্থিরতা সৃষ্টি করলেও তিনি নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে রাজি ছিলেন না। মঙ্গলবার রিপাবলিকানদের এক বৈঠকে ট্রাম্প বলেন, “আমি জানি আমি কী করছি,” এবং পরবর্তীতে বুধবার তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ লেখেন, “ঠাণ্ডা মাথায় থাকো! সব ঠিক হয়ে যাবে।” সে দিন সকালে এক পোস্টে তিনি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত সময় আসার কথা উল্লেখ করে বলেন, “এটা কেনার দারুণ সময়।”
তবে শেষ পর্যন্ত বাজারের চাপেই তাকে তার নীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হতে হয়। বিশেষত সরকারি বন্ডের সুদের হারে হঠাৎ করে উল্লম্ফনের কারণে অর্থনৈতিক অস্থিরতা আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে বুধবার বিকেলে ট্রাম্প সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি বেশিরভাগ দেশের জন্য ৯০ দিনের জন্য ‘পারস্পরিক শুল্ক’ স্থগিত রাখবেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ চারটি সূত্র।
সাংবাদিকদের কাছে এই সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, “আমি মনে করলাম মানুষ একটু বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। সবাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল, একটু বেশি চঞ্চল হয়ে উঠেছিল।” তবে এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদেরও বড় ভূমিকা ছিল। অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এবং হোয়াইট হাউসের সিনিয়র কর্মকর্তারা প্রেসিডেন্টকে একটি সুসংগঠিত কৌশলের পথে হাঁটতে পরামর্শ দেন। তারা চীনের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। তবে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছিলেন।
এ সিদ্ধান্তের পর প্রেসিডেন্টের দল সংবাদমাধ্যমে দাবি করে যে এটি ছিল একটি “পরিকল্পিত কৌশল”। অর্থমন্ত্রী বেসেন্ট এই পরিবর্তনকে বাজারের চাপের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে অস্বীকার করেন। তবে বুধবার যখন ট্রাম্প নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দেন তখন তিনি বলেন যে, এই সিদ্ধান্ত তার “অন্তর্জ্ঞান” থেকে এসেছে কারণ কিছু সিদ্ধান্ত কাগজ-কলমে হিসাব করে নেওয়া সম্ভব নয়।
ট্রাম্পের এই নীতিগত পরিবর্তনের খবর অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা জানতেন না। এমনকি ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ জেমিসন গ্রিয়ারও এই সিদ্ধান্তের কথা তখনই জানতে পারেন যখন তিনি কংগ্রেসের এক কমিটির সামনে শুল্কনীতি রক্ষা করতে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। যদিও অনেকে মনে করেন, প্রেসিডেন্টের শুল্ক বিরতির সিদ্ধান্তের পেছনে অর্থমন্ত্রী বেসেন্টের ভূমিকা ছিল। তবে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা দল মনে করে যে আসল কারণ ছিল বন্ড বাজারের অস্থিরতা।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি মার্কিন অর্থনীতির জন্য একটি ভয়াবহ সংকটের মুখে ঠেলে দিতে পারত। যা ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দা বা ২০২০ সালের মহামারির মতো হবে না। তবে এর দায় পুরোপুরি প্রেসিডেন্টের ওপর এসে পড়ত। ট্রাম্পের শুল্ক নীতির উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর তাদের প্রভাব কমানোর জন্য শাস্তি দেওয়া। তবে বাস্তবে এর ফলাফলে বাজারে বিপর্যয় ঘটে।
শুল্ক আরোপের আগে, ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে একাধিক বিতর্ক হয়েছিল কীভাবে এবং কোন দেশের উপর শুল্ক আরোপ করা হবে। অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট এবং বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লাটনিক সীমিত পরিসরে শুল্ক আরোপের পক্ষে ছিলেন কিন্তু হোয়াইট হাউসের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো ছিল সবচেয়ে আক্রমণাত্মক। তার মতে যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন শিল্পে বিপ্লব ঘটাতে হলে কড়া শুল্ক ব্যবস্থা জরুরি। কিন্তু ট্রাম্প শেষমেশ একটি সহজ সূত্র বেছে নেন—যে দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বেশি তাদের উপর বেশি শুল্ক।
শেষ পর্যন্ত ৪০ ঘণ্টার মধ্যে টানাপোড়েনের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুল্ক নীতিতে এক নতুন মোড় নিয়ে আসেন। তিনি ৯০ দিনের জন্য পারস্পরিক শুল্ক স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এর ফলে শেয়ারবাজারে তীব্র উল্লম্ফন দেখা যায়, যা নতুন প্রশ্নের জন্ম দেয়—প্রেসিডেন্টের শেয়ারবাজার কেনার আহ্বান কি বড় বিনিয়োগকারীদের জন্য এক ধরনের সংকেত ছিল?
ট্রাম্পের এই শুল্ক নীতির অস্থিরতা এবং সিদ্ধান্তের পরিবর্তন আসলে বিশ্ববাজারের জন্য একটি বড় সতর্ক সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে।

