চার দিন ব্যাপী বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫ ছিল দেশের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ ও কৌশলগত বিনিয়োগ প্রচারমূলক আয়োজন। এর মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের কাছে একটি সম্ভাবনাময়, নিরাপদ এবং লাভজনক গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরা। একইসঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব গড়ে তোলাও ছিল এ সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
সম্মেলনের কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে ছিল বিনিয়োগবান্ধব সংস্কার কার্যক্রম তুলে ধরা, বিদেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা, নীতিনির্ধারক, উদ্যোক্তা ও বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে সংযোগ স্থাপন, সম্ভাবনাময় খাতগুলোর প্রচার এবং নিরাপদ ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিবেশে আস্থা তৈরি।
সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সৌদি আরব ও চীনের মতো কৌশলগত গুরুত্বসম্পন্ন অন্তত ২৫টি দেশের বিনিয়োগ প্রতিনিধি অংশ নেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি, উপদেষ্টা, আমলা এবং বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের নেতারা। তারা সরাসরি বৈঠকে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ ও উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন। এই অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ সম্পর্কে একটি ইতিবাচক বার্তা পাঠাতে সক্ষম হয়েছে।
সম্মেলনের অন্যতম অর্জন হিসেবে বিডা জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে, যার অনেকগুলো প্রকল্প এখনো প্রাথমিক আলোচনার পর্যায়ে থাকলেও সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। চট্টগ্রাম, মিরসরাই ও আড়াইহাজারের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শনের সুযোগ পেয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সরাসরি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন যা আগ্রহ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, ফার্মাসিউটিক্যাল, ডিজিটাল ইকোনমি ও টেক্সটাইল—এই পাঁচটি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিনিয়োগের সুযোগ তুলে ধরা হয়েছে এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এবারই প্রথমবারের মতো বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি ও প্রকল্পগুলোর একটি সংগঠিত তালিকা তৈরি হয়েছে। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান নিজেই স্বীকার করেছেন, অতীতে বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি দেওয়া প্রকল্পগুলোর ফলোআপে ঘাটতি ছিল কারণ কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা ছিল না। এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে সেই ঘাটতি কাটিয়ে একটি পরিকল্পিত ও টার্গেটভিত্তিক কর্মপদ্ধতির সূচনা হয়েছে।
বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এই সম্মেলনে সরাসরি তাদের সমস্যা ও মতামত সরকারের নীতিনির্ধারকদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছেন যা ভবিষ্যতে একটি কার্যকর যোগাযোগের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। তবে সম্মেলনে উত্থাপিত সমস্যাগুলোর—যেমন আমলাতন্ত্র, জটিল করনীতি, ও দীর্ঘ অনুমোদন প্রক্রিয়া—বাস্তব সমাধান দ্রুত না এলে বিনিয়োগ প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন।
সম্মেলন ঘিরে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও আগ্রহ তৈরি হয়েছে। অনেকেই জানতে চেয়েছেন, এ সম্মেলন থেকে বাংলাদেশ কত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পেরেছে। আয়োজকরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, এই সম্মেলনের লক্ষ্য তাৎক্ষণিক চুক্তি নয় বরং দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগে আস্থা তৈরির একটি প্রক্রিয়া শুরু করা। এই আস্থার ভিত্তি তৈরির জন্য সরকারের নীতিগত অগ্রগতি, সমস্যা সমাধানের বাস্তব উদ্যোগ এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করাই হবে মূল চাবিকাঠি।
এই আয়োজনে সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা আর অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যয় করেছে আরো প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সম্মেলনের মোট খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে বিডা চেয়ারম্যান আরো জানান, ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে যা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ পরিকল্পনা ঢেলে সাজানোর ইঙ্গিত বহন করে।
অবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫ শুধুমাত্র একটি প্রদর্শনীমূলক আয়োজন ছিল না বরং এটি ছিল একান্ত প্রয়াস দেশের বিনিয়োগ অবকাঠামো, নীতিগত সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলোকে আন্তর্জাতিক পরিসরে দৃশ্যমান করার। এই সম্মেলনের প্রকৃত সফলতা নির্ভর করছে কত দ্রুত ও কার্যকরভাবে প্রতিশ্রুত নীতিগুলো বাস্তবায়ন করা যায় এবং কতটা দক্ষতার সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের আস্থার প্রতিদান দেওয়া যায় তার ওপর। এসব যদি বাস্তবে রূপ নেয় তবে নিঃসন্দেহে এই সম্মেলন বাংলাদেশ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘোরানো মাইলফলক হয়ে থাকবে।

